হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান, অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান! মানুষের অধিকারে বঞ্চিত করেছ যারে, সম্মুখে দাঁড়ায়ে রেখে তবু কোলে দাও নাই স্থান, অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান। মানুষের পরশেরে প্রতিদিন ঠেকাইয়া দূরে ঘৃণা করিয়াছ তুমি মানুষের প্রাণের ঠাকুরে। বিধাতার রুদ্ররোষে দুর্ভিক্ষের দ্বারে বসে ভাগ করে খেতে হবে সকলের সাথে অন্নপান। অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান। তোমার আসন হতে যেথায় তাদের দিলে ঠেলে সেথায় শক্তিরে তব নির্বাসন দিলে অবহেলে। চরণে দলিত হয়ে ধুলায় সে যায় বয়ে সে নিম্নে নেমে এসো, নহিলে নাহি রে পরিত্রাণ। অপমানে হতে হবে আজি তোরে সবার সমান। যারে তুমি নীচে ফেল সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে। অজ্ঞানের অন্ধকারে আড়ালে ঢাকিছ যারে তোমার মঙ্গল ঢাকি গড়িছে সে ঘোর ব্যবধান। অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান। শতেক শতাব্দী ধরে নামে শিরে অসম্মানভার, মানুষের নারায়ণে তবুও কর না নমস্কার। তবু নত করি আঁখি দেখিবারে পাও না কি নেমেছে ধুলার তলে হীন পতিতের ভগবান, অপমানে হতে হবে সেথা তোরে সবার সমান। দেখিতে পাও না তুমি মৃত্যুদূত দাঁড়ায়েছে দ্বারে, অভিশাপ আঁকি দিল তোমার জাতির অহংকারে। সবারে না যদি ডাক', এখনো সরিয়া থাক', আপনারে বেঁধে রাখ' চৌদিকে জড়ায়ে অভিমান-- মৃত্যুমাঝে হবে তবে চিতাভস্মে সবার সমান।
মা, যদি তুই আকাশ হতিস, আমি চাঁপার গাছ, তোর সাথে মোর বিনি-কথায় হত কথার নাচ। তোর হাওয়া মোর ডালে ডালে কেবল থেকে থেকে কত রকম নাচন দিয়ে আমায় যেত ডেকে। মা ব'লে তার সাড়া দেব কথা কোথায় পাই, পাতায় পাতায় সাড়া আমার নেচে উঠত তাই। তোর আলো মোর শিশির-ফোঁটায় আমার কানে কানে টলমলিয়ে কী বলত যে ঝলমলানির গানে। আমি তখন ফুটিয়ে দিতেম আমার যত কুঁড়ি, কথা কইতে গিয়ে তারা নাচন দিত জুড়ি। উড়ো মেঘের ছায়াটি তোর কোথায় থেকে এসে আমার ছায়ায় ঘনিয়ে উঠে' কোথায় যেত ভেসে। সেই হত তোর বাদল-বেলার রূপকথাটির মতো; রাজপুত্তুর ঘর ছেড়ে যায় পেরিয়ে রাজ্য কত; সেই আমারে বলে যেত কোথায় আলেখ-লতা, সাগরপারের দৈত্যপুরের রাজকন্যার কথা; দেখতে পেতেম দুয়োরানীর চক্ষু ভর-ভর, শিউরে উঠে পাতা আমার কাঁপত থরথর। হঠাৎ কখন বৃষ্টি তোমার হাওয়ার পাছে পাছে নামত আমার পাতায় পাতায় টাপুর-টুপুর নাচে; সেই হত তোর কাঁদন-সুরে রামায়ণের পড়া, সেই হত তোর গুনগুনিয়ে শ্রাবণ-দিনের ছড়া। মা, তুই হতিস নীলবরনী, আমি সবুজ কাঁচা; তোর হত, মা, আলোর হাসি, আমার পাতার নাচা। তোর হত, মা, উপর থেকে নয়ন মেলে চাওয়া, আমার হত আঁকুবাঁকু হাত তুলে গান গাওয়া। তোর হত, মা চিরকালের তারার মণিমালা, আমার হত দিনে দিনে ফুল-ফোটাবার পালা।