আমি যারে ভালোবাসি সে ছিল এই গাঁয়ে, বাঁকা পথের ডাহিন পাশে, ভাঙা ঘাটের বাঁয়ে। কে জানে এই গ্রাম, কে জানে এর নাম, খেতের ধারে মাঠের পারে বনের ঘন ছায়ে-- শুধু আমার হৃদয় জানে সে ছিল এই গাঁয়ে। বেণুশাখারা আড়াল দিয়ে চেয়ে আকাশ-পানে কত সাঁঝের চাঁদ-ওঠা সে দেখেছে এইখানে। কত আষাঢ় মাসে ভিজে মাটির বাসে বাদলা হাওয়া বয়ে গেছে তাদের কাঁচা ধানে। সে-সব ঘনঘটার দিনে সে ছিল এইখানে। এই দিঘি, ওই আমের বাগান, ওই-যে শিবালয়, এই আঙিনা ডাক-নামে তার জানে পরিচয়। এই পুকুরে তারি, সাঁতার-কাটা বারি, ঘাটের পথরেখা তারি চরণ-লেখা-ময়। এই গাঁয়ে সে ছিল কে সেই জানে পরিচয়। এই যাহারা কলস নিয়ে দাঁড়ায় ঘাটে আসি এরা সবাই দেখেছিল তারি মুখের হাসি। কুশল পুছি তারে দাঁড়াত তার দ্বারে লাঙল কাঁধে চলছে মাঠে ওই-যে প্রাচীন চাষি। সে ছিল এই গাঁয়ে আমি যারে ভালোবাসি। পালের তরী কত-যে যায় বহি দখিনবায়ে, দূর প্রবাসের পথিক এসে বসে বকুলছায়ে। পারের যাত্রিদলে খেয়ার ঘাটে চলে, কেউ গো চেয়ে দেখে না ওই ভাঙা ঘাটের বাঁয়ে। আমি যারে ভালোবাসি সে ছিল এই গাঁয়ে।
কত দিবা কত বিভাবরী কত নদী নদে লক্ষ স্রোতের মাঝখানে এক পথ ধরি, কত ঘাটে ঘাটে লাগায়ে, কত সারিগান জাগায়ে, কত অঘ্রানে নব নব ধানে কতবার কত বোঝা ভরি কর্ণধার হে কর্ণধার, বেচে কিনে কত স্বর্ণভার কোন্ গ্রামে আজ সাধিতে কী কাজ বাঁধিয়া ধরিলে তব তরী। হেথা বিকিকিনি কার হাটে। কেন এত ত্বরা লইয়া পসরা, ছুটে চলে এরা কোন্ বাটে। শুন গো থাকিয়া থাকিয়া বোঝা লয়ে যায় হাঁকিয়া, সে করুণ স্বরে মন কী যে করে-- কী ভেবে আমার দিন কাটে। কর্ণধার হে কর্ণধার, বেচে কিনে লও স্বর্ণভার-- হেথা কারা রয় লহো পরিচয়, কারা আসে যায় এই ঘাটে। যেথা হতে যাই, যাই কেঁদে। এমনটি আর পাব কি আবার সরে না যে মন সেই খেদে। সে-সব কাঁদন ভুলালে, কী দোলায় প্রাণ দুলালে। হোথা যারা তীরে আনমনে ফিরে আমি তাহাদের মরি সেধে। কর্ণধার হে কর্ণধার, বেচে কিনে লও স্বর্ণভার। এই হাটে নামি দেখে লব আমি-- এক বেলা তরী রাখো বেঁধে। গান ধর তুমি কোন্ সুরে। মনে পড়ে যায় দূর হতে এনু, যেতে হবে পুন কোন্ দূরে। শুনে মনে পড়ে, দুজনে খেলেছি সজনে বিজনে, সে যে কত দেশ নাহি তার শেষ-- সে যে কতকাল এনু ঘুরে। কর্ণধার হে কর্ণধার, বেচে কিনে লও স্বর্ণভার। বাজিয়াছে শাঁখ, পড়িয়াছে ডাক সে কোন্ অচেনা রাজপুরে।