দোতলার জানলা থেকে চোখে পড়ে পুকুরের একটি কোণা। ভাদ্রমাসে কানায় কানায় জল। জলে গাছের গভীর ছায়া টল্টল্ করছে সবুজ রেশমের আভায়। তীরে তীরে কলমি শাক আর হেলঞ্চ। ঢালু পাড়িতে সুপারি গাছ ক'টা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। এ ধারের ডাঙায় করবী, সাদা রঙন, একটি শিউলি; দুটি অযত্নের রজনীগন্ধায় ফুল ধরেছে গরিবের মতো। বাঁখারি-বাঁধা মেহেদির বেড়া, তার ও পারে কলা পেয়ারা নারকেলের বাগান; আরো দূরে গাছপালার মধ্যে একটা কোঠাবাড়ির ছাদ, উপর থেকে শাড়ি ঝুলছে। মাথায় ভিজে চাদর জড়ানো গা-খোলা মোটা মানুষটি ছিপ ফেলে বসে আছে বাঁধা ঘাটের পৈঁঠাতে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা যায় কেটে। বেলা পড়ে এল। বৃষ্টি-ধোওয়া আকাশ, বিকেলের প্রৌঢ় আলোয় বৈরাগ্যের ম্লানতা। ধীরে ধীরে হাওয়া দিয়েছে, টলমল করছে পুকুরের জল, ঝিল্মিল্ করছে বাতাবি লেবুর পাতা। চেয়ে দেখি আর মনে হয় এ যেন আর কোনো-একটা দিনের আবছায়া; আধুনিকের বেড়ার ফাঁক দিয়ে দূর কালের কার একটি ছবি নিয়ে এল মনে। স্পর্শ তার করুণ, স্নিগ্ধ তার কণ্ঠ, মুগ্ধ সরল তার কালো চোখের দৃষ্টি। তার সাদা শাড়ির রাঙা চওড়া পাড় দুটি পা ঘিরে ঢেকে পড়েছে; সে আঙিনাতে আসন বিছিয়ে দেয়, সে আঁচল দিয়ে ধুলো দেয় মুছিয়ে; সে আম-কাঁঠালের ছায়ায় ছায়ায় জল তুলে আনে, তখন দোয়েল ডাকে শজনের ডালে, ফিঙে লেজ দুলিয়ে বেড়ায় খেজুরের ঝোপে। যখন তার কাছে বিদায় নিয়ে চলে আসি সে ভালো করে কিছুই বলতে পারে না; কপাট অল্প একটু ফাঁক করে পথের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।
আলোকে আসিয়া এরা লীলা করে যায়, আঁধারেতে চলে যায় বাহিরে। ভাবে মনে, বৃথা এই আসা আর যাওয়া, অর্থ কিছুই এর নাহি রে। কেন আসি, কেন হাসি, কেন আঁখিজলে ভাসি, কার কথা বলে যাই, কার গান গাহি রে-- অর্থ কিছুই তার নাহি রে। ওরে মন, আয় তুই সাজ ফেলে আয়, মিছে কী করিস নাট-বেদীতে। বুঝিতে চাহিস যদি বাহিরেতে আয়, খেলা ছেড়ে আয় খেলা দেখিতে। ওই দেখ্ নাটশালা পরিয়াছে দীপমালা, সকল রহস্য তুই চাস যদি ভেদিতে নিজে না ফিরিলে নাট-বেদীতে। নেমে এসে দূরে এসে দাঁড়াবি যখন-- দেখিবি কেবল, নাহি খুঁজিবি, এই হাসি-রোদনের মহানাটকের অর্থ তখন কিছু বুঝিবি। একের সহিত একে মিলাইয়া নিবি দেখে, বুঝে নিবি, বিধাতার সাথে নাহি যুঝিবি-- দেখিবি কেবল, নাহি খুঁজিবি।
ছবি আঁকার মানুষ ওগো পথিক চিরকেলে, চলছ তুমি আশেপাশে দৃষ্টির জাল ফেলে। পথ-চলা সেই দেখাগুলো লাইন দিয়ে এঁকে পাঠিয়ে দিলে দেশ-বিদেশের থেকে। যাহা-তাহা যেমন-তেমন আছে কতই কী যে, তোমার চোখে ভেদ ঘটে নাই চণ্ডালে আর দ্বিজে। ঐ যে গরিবপাড়া, আর কিছু নেই ঘেঁষাঘেঁষি কয়টা কুটীর ছাড়া। তার ওপারে শুধু চৈত্রমাসের মাঠ করছে ধু ধু। এদের পানে চক্ষু মেলে কেউ কভু কি দাঁড়ায়, ইচ্ছে ক'রে এ ঘরগুলোর ছায়া কি কেউ মাড়ায়। তুমি বললে, দেখার ওরা অযোগ্য নয় মোটে; সেই কথাটিই তুলির রেখায় তক্ষনি যায় রটে। হঠাৎ তখন ঝেঁকে উঠে আমরা বলি, তাই তো, দেখার মতোই জিনিস বটে, সন্দেহ তার নাই তো। ঐযে কারা পথে চলে, কেউ করে বিশ্রাম, নেই বললেই হয় ওরা সব, পোঁছে না কেউ নাম-- তোমার কলম বললে, ওরা খুব আছে এই জেনো; অমনি বলি, তাই বটে তো, সবাই চেনো-চেনো। ওরাই আছে, নেইকো কেবল বাদশা কিংবা নবাব; এই ধরণীর মাটির কোলে থাকাই ওদের স্বভাব। অনেক খরচ ক'রে রাজা আপন ছবি আঁকায়, তার পানে কি রসিক লোকে কেউ কখনো তাকায়। সে-সব ছবি সাজে-সজ্জায় বোকার লাগায় ধাধাঁ, আর এরা সব সত্যি মানুষ সহজ রূপেই বাঁধা। ওগো চিত্রী, এবার তোমার কেমন খেয়াল এ যে, এঁকে বসলে ছাগল একটা উচ্চশ্রবা ত্যেজে। জন্তুটা তো পায় না খাতির হঠাৎ চোখে ঠেকলে, সবাই ওঠে হাঁ হাঁ ক'রে সবজি-খেতে দেখলে। আজ তুমি তার ছাগলামিটা ফোটালে যেই দেহে এক মুহূর্তে চমক লেগে বলে উঠলেম, কে হে। ওরে ছাগলওয়ালা, এটা তোরা ভাবিস কার-- আমি জানি, একজনের এই প্রথম আবিষ্কার।