আজ শরতের আলোয় এই যে চেয়ে দেখি মনে হয় এ যেন আমার প্রথম দেখা। আমি দেখলেম নবীনকে, প্রতিদিনের ক্লান্ত চোখ যার দর্শন হারিয়েছে। কল্পনা করছি,-- অনাগত যুগ থেকে তীর্থযাত্রী আমি ভেসে এসেছি মন্ত্রবলে। উজান স্বপ্নের স্রোতে পৌঁছলেম এই মুহূর্তেই বর্তমান শতাব্দীর ঘাটে। কেবলি তাকিয়ে আছি উৎসুক চোখে। আপনাকে দেখছি আপনার বাইরে,-- অন্যযুগের অজানা আমি অভ্যস্ত পরিচয়ের পরপারে। তাই তাকে নিয়ে এত গভীর কৌতূহল। যার দিকে তাকাই চক্ষু তাকে আঁকড়িয়ে থাকে পুষ্পলগ্ন ভ্রমরের মতো। আমার নগ্নচিত্ত আজ মগ্ন হয়েছে সমস্তের মাঝে। জনশ্রুতির মলিন হাতের দাগ লেগে যার রূপ হয়েছে অবলুপ্ত, যা পরেছে তুচ্ছতার মলিন চীর তার সে জীর্ণ উত্তরীয় আজ গেল খ'সে। দেখা দিল সে অস্তিত্বের পূর্ণ মূল্যে। দেখা দিল সে অনির্বচনীয়তায়। যে বোবা আজ পর্যন্ত ভাষা পায়নি জগতের সেই অতি প্রকাণ্ড উপেক্ষিত আমার সামনে খুলেছে তার অচল মৌন, ভোর-হয়ে-ওঠা বিপুল রাত্রির প্রান্তে প্রথম চঞ্চল বাণী জাগল যেন। আমার এতকালের কাছের জগতে আমি ভ্রমণ করতে বেরিয়েছি দূরের পথিক। তার আধুনিকের ছিন্নতার ফাঁকে ফাঁকে দেখা দিয়েছে চিরকালের রহস্য। সহমরণের বধূ বুঝি এমনি ক'রেই দেখতে পায় মৃত্যুর ছিন্নপর্দার ভিতর দিয়ে নূতন চোখে চিরজীবনের অম্লান স্বরূপ।
সে যখন বিদায় নিয়ে গেল, তখন নবমীর চাঁদ অস্তাচলে যায়। গভীর রাতি নিঝুম চারি দিক, আকাশেতে তারা অনিমিখ, ধরণী নীরবে ঘুমায়। হাত দুটি তার ধরে দুই হাতে মুখের পানে চেয়ে সে রহিল, কাননে বকুল তরুতলে একটিও সে কথা না কহিল। অধরে প্রাণের মলিন ছায়া, চোখের জলে মলিন চাঁদের আলো, যাবার বেলা দুটি কথা ব'লে বনপথ দিয়ে সে চলে গেল। ঘন গাছের পাতার মাঝে আঁধার পাখি গুটিয়ে পাখা, তারি উপর চাঁদের আলো শুয়েছে, ছায়াগুলি এলিয়ে দেহ আঁচলখানি পেতে যেন গাছের তলায় ঘুমিয়ে রয়েছে। গভীর রাতে বাতাসটি নেই-- নিশীথে সরসীর জলে কাঁপে না বনের কালো ছায়া, ঘুম যেন ঘোমটা-পরা বসে আছে ঝোপেঝাপে, পড়ছে বসে কী যেন এক মায়া। চুপ ক'রে হেলে সে বকুল গাছে, রমণী একেলা দাঁড়ায়ে আছে। এলোথেলো চুলের মাঝে বিষাদমাখা সে মুখখানি, চাঁদের আলো পড়েছে তার 'পরে। পথের পানে চেয়ে ছিল, পথের পানেই চেয়ে আছে, পলক নাহি তিলেক কালের তরে। গেল রে কে চলে গেল, ধীরে ধীরে চলে গেল, কী কথা সে বলে গেল হায়, অতি দূর অশথের ছায়ে মিশায়ে কে গেল রে, রমণী দাঁড়ায়ে জোছনায়। সীমাহীন জগতের মাঝে আশা তার হারায়ে গেল, আজি এই গভীরে নিশীথে, শূন্য অন্ধকারখানি মলিন মুখশ্রী নিয়ে দাঁড়িয়ে রহিল একভিতে। পশ্চিমের আকাশসীমায় চাঁদখানি অস্তে যায় যায়। ছোটো ছোটো মেঘগুলি সাদা সাদা পাখা তুলি চলে যায় চাঁদের চুমো নিয়ে, আঁধার গাছের ছায় ডুবু ডুবু জোছনায় ম্লানমুখী রমণী দাঁড়িয়ে।