১ স্তব্ধরাতে একদিন নিদ্রাহীন আবেগের আন্দোলনে তুমি বলেছিলে নতশিরে অশ্রুনীরে ধীরে মোর করতল চুমি-- "তুমি দূরে যাও যদি, নিরবধি শূন্যতার সীমাশূন্য ভারে সমস্ত ভুবন মম মরুসম রুক্ষ হয়ে যাবে একেবারে। আকাশবিস্তীর্ণ ক্লান্তি সব শান্তি চিত্ত হতে করিবে হরণ-- নিরানন্দ নিরালোক স্তব্ধ শোক মরণের অধিক মরণ।' ২ শুনে, তোর মুখখানি বক্ষে আনি বলেছিনু তোরে কানে কানে-- "তুই যদি যাস দূরে তোরি সুরে বেদনা-বিদ্যুৎ গানে গানে ঝলিয়া উঠিবে নিত্য, মোর চিত্ত সচকিবে আলোকে আলোকে। বিরহ বিচিত্র খেলা সারা বেলা পাতিবে আমার বক্ষে চোখে। তুমি খুঁজে পাবে প্রিয়ে, দূরে গিয়ে মর্মের নিকটতম দ্বার-- আমার ভুবনে তবে পূর্ণ হবে তোমার চরম অধিকার।' ৩ দুজনের সেই বাণী কানাকানি, শুনেছিল সপ্তর্ষির তারা; রজনীগন্ধার বনে ক্ষণে ক্ষণে বহে গেল সে বাণীর ধারা। তার পরে চুপে চুপে মৃত্যু রূপে মধ্যে এল বিচ্ছেদ অপার। দেখাশুনা হল সারা, স্পর্শহারা সে অনন্তে বাক্য নাহি আর। তবু শূন্য শূন্য নয়, ব্যথাময় অগ্নিবাষ্পে পূর্ণ সে গগন। একা-একা সে অগ্নিতে দীপ্তগীতে সৃষ্টি করি স্বপ্নের ভুবন।
রেলগাড়ির কামরায় হঠাৎ দেখা, ভাবি নি সম্ভব হবে কোনোদিন। আগে ওকে বারবার দেখেছি লালরঙের শাড়িতে দালিম ফুলের মতো রাঙা; আজ পরেছে কালো রেশমের কাপড়, আঁচল তুলেছে মাথায় দোলনচাঁপার মতো চিকনগৌর মুখখানি ঘিরে। মনে হল, কালো রঙে একটা গভীর দূরত্ব ঘনিয়ে নিয়েছে নিজের চার দিকে, যে দূরত্ব সর্ষেখেতের শেষ সীমানায় শালবনের নীলাঞ্জনে। থমকে গেল আমার সমস্ত মনটা; চেনা লোককে দেখলেম অচেনার গাম্ভীর্যে। হঠাৎ খবরের কাগজ ফেলে দিয়ে আমাকে করলে নমস্কার। সমাজবিধির পথ গেল খুলে, আলাপ করলেম শুরু -- কেমন আছ, কেমন চলছে সংসার ইত্যাদি। সে রইল জানলার বাইরের দিকে চেয়ে যেন কাছের দিনের ছোঁয়াচ-পার-হওয়া চাহনিতে। দিলে অত্যন্ত ছোটো দুটো-একটা জবাব, কোনোটা বা দিলেই না। বুঝিয়ে দিলে হাতের অস্থিরতায় -- কেন এ-সব কথা, এর চেয়ে অনেক ভালো চুপ করে থাকা। আমি ছিলেম অন্য বেঞ্চিতে ওর সাথিদের সঙ্গে। এক সময়ে আঙুল নেড়ে জানালে কাছে আসতে। মনে হল কম সাহস নয়; বসলুম ওর এক-বেঞ্চিতে। গাড়ির আওয়াজের আড়ালে বললে মৃদুস্বরে, "কিছু মনে কোরো না, সময় কোথা সময় নষ্ট করবার। আমাকে নামতে হবে পরের স্টেশনেই; দূরে যাবে তুমি, দেখা হবে না আর কোনোদিনই। তাই যে প্রশ্নটার জবাব এতকাল থেমে আছে, শুনব তোমার মুখে। সত্য করে বলবে তো? আমি বললেম, "বলব।" বাইরের আকাশের দিকে তাকিয়েই শুধোল, "আমাদের গেছে যে দিন একেবারেই কি গেছে, কিছুই কি নেই বাকি।" একটুকু রইলেম চুপ করে; তারপর বললেম, "রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে।" খটকা লাগল, কী জানি বানিয়ে বললেম না কি। ও বললে, "থাক্, এখন যাও ও দিকে।" সবাই নেমে গেল পরের স্টেশনে; আমি চললেম একা।