এসেছিল বহু আগে যারা মোর দ্বারে, যারা চলে গেছে একেবারে, ফাগুন-মধ্যাহ্নবেলা শিরীষছায়ায় চুপে চুপে তারা ছায়ারূপে আসে যায় হিল্লোলিত শ্যাম দুর্বাদলে। ঘন কালো দিঘিজলে পিছনে-ফিরিয়া-চাওয়া আঁখি জ্বলো জ্বলো করে ছলোছলো। মরণের অমরতালোকে ধূসর আঁচল মেলি ফিরে তারা গেরুয়া আলোকে। যে এখনো আসে নাই মোর পথে, কখনো যে আসিবে না আমার জগতে, তার ছবি আঁকিয়াছি মনে-- একেলা সে বাতায়নে বিদেশিনী জন্মকাল হতে। সে যেন শেঁউলি ভাসে ক্ষীণ মৃদু স্রোতে, কোথায় তাহার দেশ নাই সে উদ্দেশ। চেয়ে আছে দূর-পানে কার লাগি আপনি সে নাহি জানে। সেই দূরে ছায়ারূপে রয়েছে সে বিশ্বের সকল-শেষে যে আসিতে পারিত তবুও এল না কভুও। জীবনের মরীচিকাদেশে মরুকন্যাটির আঁখি ফিরে ভেসে ভেসে।
যত ঘণ্টা, যত মিনিট, সময় আছে যত শেষ যদি হয় চিরকালের মতো, তখন স্কুলে নেই বা গেলেম; কেউ যদি কয় মন্দ, আমি বলব, "দশটা বাজাই বন্ধ।" তাধিন তাধিন তাধিন। শুই নে বলে রাগিস যদি, আমি বলব তোরে, "রাত না হলে রাত হবে কী করে। নটা বাজাই থামল যখন, কেমন করে শুই। দেরি বলে নেই তো, মা, কিচ্ছুই।" তাধিন তাধিন তাধিন। যত জানিস রূপকথা, মা, সব যদি যাস বলে রাত হবে না, রাত যাবে না চলে; সময় যদি ফুরোয় তবে ফুরোয় না তো খেলা, ফুরোয় না তো গল্প বলার বেলা। তাধিন তাধিন তাধিন।
হে পদ্মা আমার, তোমায় আমায় দেখা শত শত বার। একদিন জনহীন তোমার পুলিনে, গোধূলির শুভলগ্নে হেমন্তের দিনে, সাক্ষী করি পশ্চিমের সূর্য অস্তমান তোমারে সঁপিয়াছিনু আমার পরান। অবসানসন্ধ্যালোকে আছিলে সেদিন নতমুখী বধূসম শান্ত বাক্যহীন; সন্ধ্যাতারা একাকিনী সস্নেহ কৌতুকে চেয়ে ছিল তোমাপানে হাসিভরা মুখে। সেদিনের পর হতে, হে পদ্মা আমার, তোমায় আমায় দেখা শত শত বার। নানা কর্মে মোর কাছে আসে নানা জন, নাহি জানে আমাদের পরানবন্ধন, নাহি জানে কেন আসি সন্ধ্যা-অভিসারে বালুকা শয়ন-পাতা নির্জন এ পারে। যখন মুখর তব চক্রবাকদল সুপ্ত থাকে জলাশয়ে ছাড়ি কোলাহল, যখন নিস্তব্ধ গ্রামে তব পূর্বতীরে রুদ্ধ হয়ে যায় দ্বার কুটিরে কুটিরে, তুমি কোন্ গান কর আমি কোন্ গান দুই তীরে কেহ তার পায় নি সন্ধান। নিভৃতে শরতে গ্রীষ্মে শীতে বরষায় শত বার দেখাশুনা তোমায় আমায়। কতদিন ভাবিয়াছি বসি তব তীরে পরজন্মে এ ধরায় যদি আসি ফিরে, যদি কোনো দূরতর জন্মভূমি হতে তরী বেয়ে ভেসে আসি তব খরস্রোতে-- কত গ্রাম কত মাঠ কত ঝাউঝাড় কত বালুচর কত ভেঙে-পড়া পাড় পার হয়ে এই ঠাঁই আসিব যখন জেগে উঠিবে না কোনো গভীর চেতন? জন্মান্তরে শতবার যে নির্জন তীরে গোপন হৃদয় মোর আসিত বাহিরে, আর বার সেই তীরে সে সন্ধ্যাবেলায় হবে না কি দেখাশুনা তোমায় আমায়?