নাম তার ডাক্তার ময়জন। বাতাসে মেশায় কড়া পয়জন। গণিয়া দেখিল, বড়ো বহরের একখানা রীতিমতো শহরের টিঁকে আছে নাবালক নয়জন। খুশি হয়ে ভাবে, এই গবেষণা না জানি সবার কবে হবে শোনা, শুনিতে বা বাকি রবে কয়জন।
কাকা বলেন, সময় হলে সবাই চলে যায় কোথা সেই স্বর্গ-পারে। বল্ তো কাকী সত্যি তা কি একেবারে? তিনি বলেন, যাবার আগে তন্দ্রা লাগে ঘণ্টা কখন ওঠে বাজি, দ্বারের পাশে তখন আসে ঘাটের মাঝি। বাবা গেছেন এমনি করে কখন ভোরে তখন আমি বিছানাতে। তেমনি মাখন গেল কখন অনেক রাতে। কিন্তু আমি বলছি তোমায় সকল সময় তোমার কাছেই করব খেলা, রইব জোরে গলা ধরে রাতের বেলা। সময় হলে মানব না তো, জানব না তো, ঘণ্টা মাঝির বাজল কবে। তাই কি রাজা দেবেন সাজা আমায় তবে? তোমরা বল, স্বর্গ ভালো সেথায় আলো রঙে রঙে আকাশ রাঙায়, সারা বেলা ফুলের খেলা পারুলডাঙায়! হ'ক না ভালো যত ইচ্ছে-- কেড়ে নিচ্ছে কেই বা তাকে বলো, কাকী? যেমন আছি তোমার কাছেই তেমনি থাকি! ঐ আমাদের গোলাবাড়ি, গোরুর গাড়ি পড়ে আছে চাকা-ভাঙা, গাবের ডালে পাতার লালে আকাশ রাঙা। সেথা বেড়ায় যক্ষী বুড়ী গুড়ি গুড়ি আসশেওড়ার ঝোপে ঝাপে ফুলের গাছে দোয়েল নাচে, ছায়া কাঁপে। নুকিয়ে আমি সেথা পলাই, কানাই বলাই দু-ভাই আসে পাড়ার থেকে। ভাঙা পাড়ি দোলাই নাড়ি ঝেঁকে ঝেঁকে। সন্ধ্যেবেলায় গল্প বলে রাখ কোলে, মিটমিটিয়ে জ্বলে বাতি। চালতা-শাখে পেঁচা ডাকে, বাড়ে রাতি। স্বর্গে যাওয়া দেব ফাঁকি বলছি, কাকী, দেখব আমায় কে কী করে। চিরকালই রইব খালি তোমার ঘরে।
দৃষ্টিজালে জড়ায় ওকে হাজারখানা চোখ, ধ্বনির ঝড়ে বিপন্ন ওই লোক। জন্মদিনের মুখর তিথি যারা ভুলেই থাকে, দোহাই ওগো, তাদের দলে লও এ মানুষটাকে-- সজনে পাতার মতো যাদের হালকা পরিচয়, দুলুক খসুক শব্দ নাহি হয়। সবার মাঝে পৃথক ও যে ভিড়ের কারাগারে খ্যাতি-বেড়ির নিরন্ত ঝংকারে। সবাই মিলে নানা রঙে রঙিন করছে ওরে, নিলাজ মঞ্চে রাখছে তুলে ধরে, আঙুল তুলে দেখাচ্ছে দিনরাত; কোথায় লুকোয় ভেবে না পায়, আড়াল ভূমিসাৎ। দাও-না ছেড়ে ওকে স্নিগ্ধ -আলো শ্যামল-ছায়া বিরল-কথার লোকে, বেড়াহীন বিরাট ধূলি-'পর, সেই যেখানে মহাশিশুর আদিম খেলাঘর। ভোরবেলাকার পাখির ডাকে প্রথম খেয়া এসে ঠেকল যখন সব-প্রথমের চেনাশোনার দেশে, নামল ঘাটে যখন তারে সাজ রাখে নি ঢেকে, ছুটির আলো নগ্ন গায়ে লাগল আকাশ থেকে-- যেমন করে লাগে তরীর পালে, যেমন লাগে অশোক গাছের কচি পাতার ডালে। নাম ভোলা ফুল ফুটল ঘাসে ঘাসে সেই প্রভাতের সহজ অবকাশে। ছুটির যজ্ঞে পুষ্পহোমে জাগল বকুলশাখা, ছুটির শূন্যে ফাগুনবেলা মেলল সোনার পাখা। ছুটির কোণে গোপনে তার নাম আচম্কা সেই পেয়েছিল মিষ্টিসুরের দাম; কানে কানে সে নাম ডাকার ব্যথা উদাস করে চৈত্রদিনের স্তব্ধ দুইপ্রহরে। আজ সবুজ এই বনের পাতায় আলোর ঝিকিঝিকি সেই নিমেষের তারিখ দিল লিখি। তাহারে ডাক দিয়েছিল পদ্মানদীর ধারা, কাঁপন-লাগা বেণুর শিরে দেখেছে শুকতারা; কাজল-কালো মেঘের পুঞ্জ সজল সমীরণে নীল ছায়াটি বিছিয়েছিল তটের বনে বনে; ও দেখেছে গ্রামের বাঁকা বাটে কাঁখে কলস মুখর মেয়ে চলে স্নানের ঘাটে;
সর্ষেতিসির খেতে দুইরঙা সুর মিলেছিল অবাক আকাশেতে; তাই দেখেছে চেয়ে চেয়ে অস্তরবির রাগে-- বলেছিল, এই তো ভালো লাগে। সেই-যে ভালো-লাগাটি তার যাক সে রেখে পিছে, কীর্তি যা সে গেঁথেছিল হয় যদি হোক মিছে, না যদি রয় নাই রহিল নাম-- এই মাটিতে রইল তাহার বিস্মিত প্রণাম।