আমি তখন ছিলেম শিলঙ পাহাড়ে, রূপভাবক নন্দলাল ছিলেন কার্সিয়ঙে। তাঁর কাছ থেকে ছোটো একটি পত্রপট পাওয়া গেল, তাতে পাহাড়ের উপর দেওদার গাছের ছবি আঁকা। চেয়ে চেয়ে মনে হল, ঐ একটি দেবদারুর মধ্যে যে শ্যামল শক্তির প্রকাশ , সমস্ত পর্বতের চেয়ে তা বড়ো, ঐ দেবদারুকে দেখা গেল হিমালয়ের তপস্যার সিদ্ধিরূপে। মহাকালের চরণপাতে হিমালয়ের প্রতিদিন ক্ষয় হচ্ছে, কিন্তু দেবদারুর মধ্যে যে প্রাণ, নব নব তরুদেহের মধ্যে দিয়ে যুগে যুগে তা এগিয়ে চলবে। শিল্পীর পত্রপটের প্রত্যুত্তরে আমি এই কাব্যলিপি পাঠিয়ে দিলেম। তপোমগ্ন হিমাদ্রি ব্রহ্মরন্ধ্র ভেদ করি চুপে বিপুল প্রাণের শিখা উচ্ছ্বসিল দেবদারুরূপে। সূর্যের যে জ্যোতির্মন্ত্র তপস্বীর নিত্য-উচ্চারণ অন্তরের অন্ধকারে, পারিল না করিতে ধারণ সেই দীপ্ত রুদ্রবাণী-- তপস্যার সৃষ্টিশক্তিবলে সে বাণী ধরিল শ্যামকায়া; সবিতার সভাতলে করিল সাবিত্রীগান;স্পন্দমান ছন্দের মর্মরে ধরিত্রীর সামগাথা বিস্তারিল অনন্ত অম্বরে। ঋজু দীর্ঘ দেবদারু-- গিরি এরে শ্রেষ্ঠ করে জ্ঞান আপন মহিমা চেয়ে; অন্তরে ছিল যে তার ধ্যান বাহিরে তা সত্য হল; ঊর্ধ্ব হতে পেয়েছিল ঋণ, ঊর্ধ্বপানে অর্ঘ্যরূপে শোধ করি দিল একদিন। আপন দানের পুণ্যে স্বর্গ তার রহিল না দূর, সূর্যের সংগীতে মেশে মৃত্তিকার মুরলীর সুর।
হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান, অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান! মানুষের অধিকারে বঞ্চিত করেছ যারে, সম্মুখে দাঁড়ায়ে রেখে তবু কোলে দাও নাই স্থান, অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান। মানুষের পরশেরে প্রতিদিন ঠেকাইয়া দূরে ঘৃণা করিয়াছ তুমি মানুষের প্রাণের ঠাকুরে। বিধাতার রুদ্ররোষে দুর্ভিক্ষের দ্বারে বসে ভাগ করে খেতে হবে সকলের সাথে অন্নপান। অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান। তোমার আসন হতে যেথায় তাদের দিলে ঠেলে সেথায় শক্তিরে তব নির্বাসন দিলে অবহেলে। চরণে দলিত হয়ে ধুলায় সে যায় বয়ে সে নিম্নে নেমে এসো, নহিলে নাহি রে পরিত্রাণ। অপমানে হতে হবে আজি তোরে সবার সমান। যারে তুমি নীচে ফেল সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে। অজ্ঞানের অন্ধকারে আড়ালে ঢাকিছ যারে তোমার মঙ্গল ঢাকি গড়িছে সে ঘোর ব্যবধান। অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান। শতেক শতাব্দী ধরে নামে শিরে অসম্মানভার, মানুষের নারায়ণে তবুও কর না নমস্কার। তবু নত করি আঁখি দেখিবারে পাও না কি নেমেছে ধুলার তলে হীন পতিতের ভগবান, অপমানে হতে হবে সেথা তোরে সবার সমান। দেখিতে পাও না তুমি মৃত্যুদূত দাঁড়ায়েছে দ্বারে, অভিশাপ আঁকি দিল তোমার জাতির অহংকারে। সবারে না যদি ডাক', এখনো সরিয়া থাক', আপনারে বেঁধে রাখ' চৌদিকে জড়ায়ে অভিমান-- মৃত্যুমাঝে হবে তবে চিতাভস্মে সবার সমান।