আমার কাব্যের ঋতুপরিবর্তন ঘটেছে বারে বারে। প্রায়ই সেটা ঘটে নিজের অলক্ষ্যে। কালে কালে ফুলের ফসল বদল হয়ে থাকে, তখন মৌমাছির মধু-যোগান নতুন পথ নেয়। ফুল চোখে দেখবার পূর্বেই মৌমাছি ফুলগন্ধের সূক্ষ্ম নির্দেশ পায়, সেটা পায় চারদিকের হাওয়ায়। যারা ভোগ করে এই মধু তারা এই বিশিষ্টতা টের পায় স্বাদে। কোনো কোনো বনের মধু বিগলিত তার মাধুর্যে, তার রঙ হয় রাঙা; কোনো পাহাড়ি মধু দেখি ঘন, আর তাতে রঙের আবেদন নেই, সে শুভ্র; আবার কোনো আরণ্য সঞ্চয়ে একটু তিক্ত স্বাদেরও আভাস থাকে। কাব্যে এই যে হাওয়াবদল থেকে সৃষ্টিবদল এ তো স্বাভাবিক, এমনি স্বাভাবিক যে এর কাজ হতে থাকে অন্যমনে। কবির এ সম্বন্ধে খেয়াল থাকে না। বাইরে থেকে সমজদারের কাছে এর প্রবণতা ধরা পড়ে। সম্প্রতি সেই সমজদারের সাড়া পেয়েছিলুম। আমার একশ্রেণীর কবিতার এই বিশিষ্টতা আমার স্নেহভাজন বন্ধু অমিয়চন্দ্রের দৃষ্টিতে পড়েছিল। ঠিক কী ভাবে তিনি এদের বিশ্লেষণ করে পৃথক করেছিলেন তা আমি বলতে পারি নে। হয়তো দেখেছিলেন, এরা বসন্তের ফুল নয়; এরা হয়তো প্রৌঢ় ঋতুর ফসল, বাইরে থেকে মন ভোলাবার দিকে এদের ঔদাসীন্য। ভিতরের দিকের মননজাত অভিজ্ঞতা এদের পেয়ে বসেছে। তাই যদি না হবে তা হলে তো ব্যর্থ হবে পরিণত বয়সের প্রেরণা। কিন্তু এ আলোচনা আমার পক্ষে সংগত নয়। আমি তাই নবজাতক গ্রন্থের কাব্যগ্রন্থনের ভার অমিয়চন্দ্রের উপরেই দিয়েছিলুম। নিশ্চিন্ত ছিলুম, কারণ দেশবিদেশের সাহিত্যে ব্যাপকক্ষেত্রে তাঁর সঞ্চরণ।
মনে আছে কার দেওয়া সেই ফুল? সে ফুল যদি শুকিয়ে গিয়ে থাকে তবে তারে সাজিয়ে রাখাই ভুল -- মিথ্যে কেন কাঁদিয়ে রাখ তাকে। ধুলায় তারি শান্তি তারি গতি, এই সমাদর কোরো তাহার প্রতি -- সময় যখন গেছে তখন তারে ভুলো একেবারে। মাঘের শেষে নাগকেশরের ফুলে আকাশে বয় মন-হারানো হাওয়া; বনের বক্ষ উঠেছে আজ দুলে, চামেলি ওই কার যেন পথ-চাওয়া। ছায়ায় ছায়ায় কাদের কানাকানি, চোখে-চোখে নীরব জানাজানি -- এ উৎসবে শুকনো ফুলের লাজ ঘুচিয়ে দিয়ো আজ। যদি-বা তার ফুরিয়ে থাকে বেলা, মনে জেনো দুঃখ তাহে নাই; করেছিল ক্ষণকালের খেলা, পেয়েছিল ক্ষণকালের ঠাঁই। অলকে সে কানের কাছে দুলি বলেছিল নীরব কথাগুলি, গন্ধ তাহার ফিরেছে পথ ভুলে তোমার এলোচুলে। সেই মাধুরী আজ কি হবে ফাঁকি। লুকিয়ে সে কি রয় নি কোনোখানে। কাহিনী তার থাকবে না আর বাকি কোনো স্বপ্নে, কোনো গন্ধে গানে? আরেক দিনের বনচ্ছায়ায় লিখা ফিরবে না কি তাহার মরীচিকা। অশ্রুতে তার আভাস দিবে নাকি আরেক দিনের আঁখি। নাহয় তাও লুপ্ত যদিই হয়, তার লাগি শোক সেও তো সেই পথে। এ জগতে সদাই ঘটে ক্ষয়, ক্ষতি তবু হয় না কোনোমতে। শুকিয়ে-পড়া পুষ্পদলের ধূলি এ ধরণী যায় যদি বা ভুলি -- সেই ধুলারই বিস্মরণের কোলে নতুন কুসুম দোলে।