কেন আসিতেছ মুগ্ধ মোর পানে ধেয়ে
ওগো দিক্‌ভ্রান্ত পান্থ, তৃষার্ত নয়ানে
লুব্ধ বেগে। আমি যে তৃষিত তোমা চেয়ে!
আমি চিরদিন থাকি এ মরুশয়ানে
সঙ্গীহারা। এ তো নহে পিপাসার জল,
এ তো নহে নিকুঞ্জের ছায়া, পক্ব ফল
মধুরসে ভরা, এ তো নহে উৎসধারে
সিঞ্চিত সরস স্নিগ্ধ নবীন শাদ্বল
নয়ননন্দন শ্যাম। পল্লবমাঝারে
কোথায় বিহঙ্গ কোথা মধুকরদল।
শুধু জেনো, একখানি বহ্নিসম-শিখা
তপ্ত বাসনার তুলি আমার সম্বল--
অনন্ত পিপাসাপটে এ কেবল লিখা
চিরতৃষার্তের স্বপ্নমায়ামরীচিকা।

মৃত্যুদূত এসেছিল হে প্রলয়ংকর, অকস্মাৎ
তব সভা হতে। নিয়ে গেল বিরাট প্রাঙ্গণে তব;
চক্ষে দেখিলাম অন্ধকার; দেখি নি অদৃশ্য আলো
আঁধারের স্তরে স্তরে অন্তরে অন্তরে, যে আলোক
নিখিল জ্যোতির জ্যোতি; দৃষ্টি মোর ছিল আচ্ছাদিয়া
আমার আপন ছায়া। সেই আলোকের সামগান
মন্দ্রিয়া উঠিবে মোর সত্তার গভীর গুহা হতে
সৃষ্টির-সীমান্ত-জ্যোতির্লোকে, তারি লাগি ছিল মোর
আমন্ত্রণ। লব আমি চরমের কবিত্বমর্যাদা
জীবনের রঙ্গভূমে, এরি লাগি সেধেছিনু তান।
বাজিল না রুদ্রবীণা নিঃশব্দ ভৈরব নবরাগে,
জাগিল না মর্মতলে ভীষণের প্রসন্ন মুরতি,
তাই ফিরাইয়া দিলে। আসিবে আরেক দিন যবে
তখন কবির বাণী পরিপক্ব ফলের মতন
নিঃশব্দে পড়িবে খসি আনন্দের পূর্ণতার ভারে
অনন্তের অর্ঘ্যডালি-'পরে। চরিতার্থ হবে শেষে
জীবনের শেষ মূল্য, শেষ যাত্রা, শেষ নিমন্ত্রণ।

আজি এ নিরালা কুঞ্জে, আমার
          অঙ্গমাঝে
বরণের ডালা সেজেছে আলোক-
          মালার সাজে।
নব বসন্তে লতায় লতায়
          পাতায় ফুলে
বাণীহিল্লোল উঠে প্রভাতের
          স্বর্ণকূলে,
আমার দেহের বাণীতে সে দোল
          উঠিছে দুলে,
এ বরণ-গান নাহি পেলে মান
          মরিব লাজে,
ওহে প্রিয়তম, দেহে মনে মম
          ছন্দ বাজে।
অর্ঘ্য তোমার আনি নি ভরিয়া
          বাহির হতে,
ভেসে আসে পূজা পূর্ণ প্রাণের
          আপন স্রোতে।
মোর তনুময় উছলে হৃদয়
          বাঁধনহারা,
অধীরতা তারি মিলনে তোমারি
          হোক-না সারা।
ঘন যামিনীর আঁধারে যেমন
          ঝলিছে তারা,
দেহ ঘেরি মম প্রাণের চমক
          তেমনি রাজে--
সচকিত আলো নেচে ওঠে মোর
          সকল কাজে।