অনেককালের একটিমাত্র দিন কেমন করে বাঁধা পড়েছিল একটা কোনো ছন্দে, কোনো গানে, কোনো ছবিতে। কালের দূত তাকে সরিয়ে রেখেছিল চলাচলের পথের বাইরে। যুগের ভাসান খেলায় অনেক কিছু চলে গেল ঘাট পেরিয়ে, সে কখন ঠেকে গিয়েছিল বাঁকের মুখে কেউ জানতে পারে নি। মাঘের বনে আমের কত বোল ধরল, কত পড়ল ঝরে; ফাল্গুনে ফুটল পলাশ, গাছতলার মাটি দিল ছেয়ে; চৈত্রের রৌদ্রে আর সর্ষের খেতে কবির লড়াই লাগল যেন মাঠে আর আকাশে। আমার সেই আটকে-পড়া দিনটির গায়ে কোনো ঋতুর কোনো তুলির চিহ্ন লাগেনি। একদা ছিলেম ঐ দিনের মাঝখানেই। দিনটা ছিল গা ছড়িয়ে নানা কিছুর মধ্যে; তারা সমস্তই ঘেঁষে ছিল আশেপাশে সামনে। তাদের দেখে গেছি সবটাই কিন্তু চোখে পড়েনি সমস্তটা। ভালোবেসেছি, ভালো করে জানিনি কতখানি বেসেছি। অনেক গেছে ফেলাছড়া; আনমনার রসের পেয়ালায় বাকি ছিল কত। সেদিনের যে পরিচয় ছিল আমার মনে আজ দেখি তার চেহারা অন্য ছাঁদের। কত এলোমেলো, কত যেমন-তেমন সব গেছে মিলিয়ে। তার মধ্যে থেকে বেরিয়ে পড়েছে যে তাকে আজ দূরের পটে দেখছি যেন সেদিনকার সে নববধূ। তনু তার দেহলতা, ধূপছায়া রঙের আঁচলটি মাথায় উঠেছে খোঁপাটুকু ছাড়িয়ে। ঠিকমতো সময়টি পাই নি। তাকে সব কথা বলবার, অনেক কথা বলা হয়েছে যখন-তখন, সে-সব বৃথা কথা। হতে হতে বেলা গেছে চলে। আজ দেখা দিয়েছে তার মূর্তি,-- স্তব্ধ সে দাঁড়িয়ে আছে ছায়া-আলোর বেড়ার মধ্যে, মনে হচ্ছে কী একটা কথা বলবে, বলা হল না,-- ইচ্ছে করছে ফিরে যাই পাশে, ফেরার পথ নেই।
মন যে তাহার হঠাৎপ্লাবনী নদীর প্রায় অভাবিত পথে সহসা কী টানে বাঁকিয়া যায়-- সে তার সহজ গতি, সেই বিমুখতা ভরা ফসলের যতই করুক ক্ষতি। বাঁধা পথে তারে বাঁধিয়া রাখিবে যদি বর্ষা নামিলে খরপ্রবাহিণী নদী ফিরে ফিরে তার ভাঙিয়া ফেলিবে কূল, ভাঙিয়া তোমার ভুল। নয় সে খেলার পুতুল, নয় সে আদরের পোষা প্রাণী, মনে রেখো তাহা জানি। মত্তপ্রবাহবেগে দুর্দাম তার ফেনিল হাস্য কখন উঠিবে জেগে। তোমার প্রাণের পণ্য আহরি ভাসাইয়া দিলে ভঙ্গুর তরী, হঠাৎ কখন পাষাণে আছাড়ি করিবে সে পরিহাস, হেলায় খেলায় ঘটাবে সর্বনাশ। এ খেলারে যদি খেলা বলি মান, হাসিতে হাস্য মিলাইতে জান, তা হলে রবে না খেদ। ঝরনার পথে উজানের খেয়া, সে যে মরণের জেদ। স্বাধীন বল' যে ওরে নিতান্ত ভুল ক'রে। দিক্সীমানার বাঁধন টুটিয়া ঘুমের ঘোরেতে চমকি উঠিয়া যে-উল্কা পড়ে খ'সে কোন্ ভাগ্যের দোষে সেই কি স্বাধীন, তেমনি স্বাধীন এও-- এরে ক্ষমা করে যেয়ো। বন্যারে নিয়ে খেলা যদি সাধ লাভের হিসাব দিয়ো তবে বাদ, গিরিনদী-সাথে বাঁধা পড়িয়ো না পণ্যের ব্যবহারে। মূল্য যাহার আছে একটুও সাবধান করি ঘরে তারে থুয়ো, খাটাতে যেয়ো না মাতাল চলার চলতি এ কারবারে। কাটিয়ো সাঁতার যদি জানা থাকে, তলিয়ে যেয়ো না আওড়ের পাকে, নিজেরে ভাসায়ে রাখিতে না জান ভরসা ডাঙার পারে-- যতই নীরস হোক-না সে তবু নিরাপদ জেনো তারে। "সে আমারি' ব'লে বৃথা অহমিকা ভালে আঁকি দেয় ব্যঙ্গের টিকা। আল্গা লীলায় নাই দেওয়া পাওয়া, দূর থেকে শুধু আসা আর যাওয়া-- মানবমনের রহস্য কিছু শিখা।