একদিন আষাঢ়ে নামল বাঁশবনের মর্মর-ঝরা ডালে জলভারে অভিভূত নীলমেঘের নিবিড় ছায়া। শুরু হল ফসল-খেতের জীবনীরচনা মাঠে মাঠে কচি ধানের চিকন অঙ্কুরে। এমন সে প্রচুর, এমন পরিপূর্ণ, এমন প্রোৎফুল্ল, দ্যুলোকে ভূলোকে বাতাসে আলোকে তার পরিচয় এমন উদার-প্রসারিত-- মনে হয় না সময়ের ছোটো বেড়ার মধ্যে তাকে কুলাতে পারে তার অপরিমেয় শ্যামলতায় আছে যেন অসীমের চির-উৎসাহ, যেমন আছে তরঙ্গ-উল্লোল সমুদ্রে। মাস যায়। শ্রাবণের স্নেহ নামে আঘাতের ছল ক'রে, সবুজ মঞ্জরি এগিয়ে চলে দিনে দিনে শিষগুলি কাঁধে তুলে নিয়ে অন্তহীন স্পর্ধিত জয়যাত্রায়। তার আত্মাভিমানী যৌবনের প্রগল্ভতার 'পরে সূর্যের আলো বিস্তার করে হাস্যোজ্জ্বল কৌতুক, নিশীথের তারা নিবিষ্ট করে নিস্তব্ধ বিস্ময়। মাস যায়। বাতাসে থেমে গেল মত্ততার আন্দোলন, শরতের শান্তনির্মল আকাশ থেকে অমন্দ্র শঙ্খধ্বনিতে বাণী এল-- প্রস্তুত হও। সারা হল শিশিরজলে স্নানব্রত। মাস যায়। নির্মম শীতের হাওয়া এসে পৌঁছল হিমাচল থেকে, সবুজের গায়ে গায়ে এঁকে দিল হল্দের ইশারা, পৃথিবীর দেওয়া রঙ বদল হল আলোর দেওয়া রঙে। উড়ে এল হাঁসের পাঁতি নদীর চরে, কাশের গুচ্ছ ঝরে পড়ল তটের পথে পথে। মাস যায়। বিকালবেলার রৌদ্রকে যেমন উজাড় করে দিনান্ত শেষ-গোধূলির ধূসরতায় তেমনি সোনার ফসল চলে গেল অন্ধকারের অবরোধে। তার পরে শূন্যমাঠে অতীতের চিহ্নগুলো কিছুদিন রইল মৃত শিকড় আঁকড়ে ধরে-- শেষে কালো হয়ে ছাই হল আগুনের লেহনে। মাস গেল। তার পরে মাঠের পথ দিয়ে গোরু নিয়ে চলে রাখাল-- কোনো ব্যথা নেই তাতে, কোনো ক্ষতি নেই কারো। প্রান্তরে আপন ছায়ায় মগ্ন একলা অশথ গাছ, সূর্য-মন্ত্র-জপ-করা ঋষির মতো। তারই তলায় দুপুরবেলায় ছেলেটা বাজায় বাঁশি আদিকালের গ্রামের সুরে। সেই সুরে তাম্রবরন তপ্ত আকাশে বাতাস হূহু করে ওঠে, সে যে বিদায়ের নিত্যভাঁটায় ভেসে-চলা মহাকালের দীর্ঘনিশ্বাস, যে কাল, যে পথিক, পিছনের পান্থশালাগুলির দিকে আর ফেরার পথ পায় না এক দিনেরও জন্যে।