আমার খোকা করে গো যদি মনে এখনি উড়ে পারে সে যেতে পারিজাতের বনে। যায় না সে কি সাধে। মায়ের বুকে মাথাটি থুয়ে সে ভালোবাসে থাকিতে শুয়ে, মায়ের মুখ না দেখে যদি পরান তার কাঁদে। আমার খোকা সকল কথা জানে। কিন্তু তার এমন ভাষা, কে বোঝে তার মানে। মৌন থাকে সাধে? মায়ের মুখে মায়ের কথা শিখিতে তার কী আকুলতা, তাকায় তাই বোবার মতো মায়ের মুখচাঁদে। খোকার ছিল রতনমণি কত-- তবু সে এল কোলের 'পরে ভিখারীটির মতো। এমন দশা সাধে? দীনের মতো করিয়া ভান কাড়িতে চাহে মায়ের প্রাণ, তাই সে এল বসনহীন সন্ন্যাসীর ছাঁদে। খোকা যে ছিল বাঁধন-বাধা-হারা -- যেখানে জাগে নূতন চাঁদ ঘুমায় শুকতারা। ধরা সে দিল সাধে? অমিয়মাখা কোমল বুকে হারাতে চাহে অসীম সুখে, মুকতি চেয়ে বাঁধন মিঠা মায়ের মায়া-ফাঁদে। আমার খোকা কাঁদিতে জানিত না, হাসির দেশে করিত শুধু সুখের আলোচনা। কাঁদিতে চাহে সাধে? মধুমুখের হাসিটি দিয়া টানে সে বটে মায়ের হিয়া, কান্না দিয়ে ব্যথার ফাঁসে দ্বিগুণ বলে বাঁধে।
পুজোর ছুটি আসে যখন বকসারেতে যাবার পথে-- দূরের দেশে যাচ্ছি ভেবে ঘুম হয় না কোনো মতে। সেখানে যেই নতুন বাসায় হপ্তা দুয়েক খেলায় কাটে দূর কি আবার পালিয়ে আসে আমাদেরি বাড়ির ঘাটে! দূরের সঙ্গে কাছের কেবল কেনই যে এই লুকোচুরি, দূর কেন যে করে এমন দিনরাত্তির ঘোরাঘুরি। আমরা যেমন ছুটি হলে ঘরবাড়ি সব ফেলে রেখে রেলে চড়ে পশ্চিমে যাই বেরিয়ে পড়ি দেশের থেকে, তেমনিতরো সকালবেলা ছুটিয়ে আলো আকাশেতে রাতের থেকে দিন যে বেরোয় দূরকে বুঝি খুঁজে পেতে? সে-ও তো যায় পশ্চিমেতেই, ঘুরে ঘুরে সন্ধ্যে হলে, তখন থেকে রাতের মাঝেই দূর সে আবার গেছে চলে। সবাই যেন পলাতকা মন টেকে না কাছের বাসায়। দলে দলে পলে পলে কেবল চলে দূরের আশায়। পাতায় পাতায় পায়ের ধ্বনি, ঢেউয়ে ঢেউয়ে ডাকাডাকি, হাওয়ায় হাওয়ায় যাওয়ার বাঁশি কেবল বাজে থাকি থাকি। আমায় এরা যেতে বলে, যদি বা যাই, জানি তবে দূরকে খুঁজে খুঁজে শেষে মায়ের কাছেই ফিরতে হবে।