আমাদের জাতীয় প্রজাসমিতি বা ইণ্ডিয়ান ন্যাশনাল কন্গ্রেসের দশম বার্ষিক অধিবেশনের সভাপতি মিঃ ওয়েব এবং হিন্দুহৈতৈষিণী শ্রমতী অ্যানি বেসেন্ট স্ব স্ব বক্তৃতাস্থলে পলিটিক্সের উপযোগিতা সম্বন্ধে আলোচনা করিয়াছেন। বিবি বেসেন্টের মতে পলিটিক্স্ ভারতবর্ষের ধাতুর সহিত ঠিক মিশ খায় না। চিন্তা করা, শিক্ষাদান করা এবং কার্যসাধন করা এই তিনের মধ্যে প্রথম দুইটি মহত্তর কার্যই ভারতবর্ষকে শোভা পায়, শেষোক্ত কার্যটা পলিটিক্সের অঙ্গ এবং তাহা ভারতবর্ষীয়ের জীবনের আদর্শ হওয়া উচিত হয় না।
আমরা "বাংলা জাতীয় সাহিত্য' প্রবন্ধের নামকরণে ইংরাজি "ন্যাশনাল' শব্দের স্থলে "জাতীয়' শব্দ ব্যবহার করিয়াছি বলিয়া "সাহিত্য'-সম্পাদক মহাশয় আমাদের প্রতি কিঞ্চিৎ শ্লেষকটাক্ষপাত করিয়াছেন। প্রথমত, অনুবাদটি আমাদের কৃত নহে; এই শব্দ বহুকাল হইতে বাংলা সাহিত্যে ন্যাশনাল-শব্দের প্রতিশব্দরূপে ব্যবহৃত হইয়া আসিতেছে। দ্বিতীয়ত, ভাষার পরিণতি সহকারে স্বাভাবিক নিয়মে অনেকগুলি শব্দের অর্থ বিস্তৃতি লাভ করে। "সাহিত্য' শব্দটি তাহার উদাহরণস্থল। সাহিত্য-সম্পাদক মহাশয়ও "সাহিত্য' শব্দটিকে ইংরাজি "লিটারেচর' অর্থে প্রয়োগ করিয়া থাকেন। সম্পাদক মহাশয় সংস্কৃতজ্ঞ, ইহা তাঁহার অবিদিত নাই যে, "লিটারেচর' শব্দের অর্থ যতদূর ব্যাপক, সাহিত্য শব্দের অর্থ ততদূর পৌঁছে না। শব্দকল্পদ্রুম অভিধানে "সাহিত্য' শব্দের অর্থ এইরূপ নির্দিষ্ট হইয়াছে "মনুষ্যকৃতশ্লোকময়গ্রন্থবিশেষঃ। স তু ভট্টিরঘুকুমারসম্ভবমাঘভারবিমেঘদূতবিদগ্ধমুখমণ্ডন-শান্তিশতকপ্রভৃতয়ঃ।' এমন-কি, রামায়ণ মহাভারতও সাহিত্যের মধ্যে গণ্য হয় নাই, তাহা ইতিহাসরূপে খ্যাত ছিল। এইজন্য মহারাষ্ট্রীয় ভাষায় "সাহিত্য' শব্দের পরিবর্তে "বাঙ্ময়' শব্দ ব্যবহৃত হইয়া থাকে। রঘুবংশের তৃতীয় সর্গে ২৭শ শ্লোকে আছে-- লিপের্যথাবদ্গ্রহণেন বাঙ্ময়ং নদীমুখেনেব সমুদ্রমাবিশৎ।
শক্তির ক্ষেত্রে যারা কাজ করে তারা অনন্ত উন্নতির কথা বলে। অর্থাৎ অনন্ত গতির উপরেই তারা জোর দেয়, অনন্ত স্থিতির উপর নয়। তারা অনন্ত চেষ্টার কথাই বলে, অনন্ত লাভের কথা বলে না। এইজন্য ধর্মনীতিই তাদের শেষ সম্বল। নীতি কিনা নিয়ে যাবার জিনিস-- তা পথের পাথেয়। যারা পথকেই মানে তারা নীতিকেই চমকরূপে মানে-- তারা গৃহের সম্বলের কথা চিন্তা করে না। কারণ, যে গৃহে কোনোকালেই মানুষ পৌঁছোবে না, সে গৃহকে মানলেও হয়, না মানলেও হয়। যে উন্নতি অনন্ত উন্নতি, তাকে উন্নতি না বললে ক্ষতি হয় না। আনন্দং ব্রহ্মণো বিদ্বান্ ন বিভেতি কদাচন জগতে তুমি রাজা অসীম প্রতাপ, হৃদয়ে তুমি হৃদয়নাথ হৃদয়হরণ রূপ। নীলাম্বর জ্যোতিখচিত চরণপ্রান্তে প্রসারিত, ফিরে সভয়ে নিয়মপথে অনন্তলোক। নিভৃত হৃদয়-মাঝে কিবা প্রসন্ন মুখচ্ছবি, প্রেমপরিপূর্ণ মধুরভাতি। ভকতহৃদয়ে তব করুণারস সতত বহে, দীনজনে সতত কর অভয়দান।