বাংলার প্রাচীন কাব্যসাহিত্য এবং আধুনিক কাব্যসাহিত্যের মাঝখানে কবি-ওয়ালাদের গান। ইহা এক নূতন সামগ্রী এবং অধিকাংশ নূতন পদার্থের ন্যায় ইহার পরমায়ু অতিশয় স্বল্প। একদিন হঠাৎ গোধূলির সময়ে যেমন পতঙ্গে আাকাশ ছাইয়া যায়| মধ্যাহ্নের আলোকেও তাহাদিগকে দেখা যায় না এবং অন্ধকার ঘনীভূত হইবার পূর্বেই তাহারা অদৃশ্য হইয়া যায়, এই কবির গানও সেইরূপ এক সময়ে বঙ্গসাহিত্যের স্বল্পক্ষণস্থায়ী গোধূলি-আকাশে অকস্মাৎ দেখা দিয়াছিল--তৎপূর্বেও তাহাদের কোনো পরিচয় ছিল না, এখনো তাহাদের কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না। গীতিকবিতা বাংলাদেশে বহুকাল হইতে চলিয়া আসিতেছে এবং গীতিকবিতাই বঙ্গসাহিত্যের প্রধান গৌরবস্থল। বৈষ্ণব কবিদের পদাবলী বসন্তকালের অপর্যাপ্ত পুষ্পমঞ্জরীর মতো; যেমন তাহার ভাবের সৌরভ তেমনি তাহার গঠনের সৌন্দর্য। রাজসভাকবি রায়গুণাকরের অন্নদামঙ্গল-গান রাজকণ্ঠের মণিমালার মতো, যেমন তাহার উজ্জ্বলতা তেমনি তাহার কারুকার্য। আমাদের বর্তমান সমালোচ্য এই "কবির গান'গুলিও গান, কিন্তু ইহাদের মধ্যে সেই ভাবের গাঢ়তা এবং গঠনের পারিপাট্য নাই। গেল গেল কুল কুল, যাক কুল-- তাহে নই আকুল। লয়েছি যাহার কুল সে আমারে প্রতিকূল॥ যদি কুলকুণ্ডলিনী অনুকূলা হন আমায় অকূলের তরী কূল পাব পুনরায়॥ এখন ব্যাকুল হয়ে কি দুকূল হারাব সই। তাহে বিপক্ষ হাসিবে যত রিপুচয়॥ একে নবীন বয়স তাতে সুসভ্য, কাব্যরসে রসিকে। মাধুর্য গাম্ভীর্য, তাতে "দাম্ভীর্য' নাই, আর আর বউ যেমন ধারা ব্যাপিকে॥ অধৈর্য হেরে তোরে স্বজনী, ধৈর্য ধরা নাহি যায়। যদি সিদ্ধ হয় সেই কার্য করব সাহায্য, বলি, তাই বলে যা আমায়॥ সাধ ক'রে করেছিলেম দুর্জয় মান, শ্যামের তায় হল অপমান। শ্যামকে সাধলেম না, ফিরে চাইলেম না, কথা কইলেম না রেখে মান॥ কৃষ্ণ সেই রাগের অনুরাগে, রাগে রাগে গো, পড়ে পাছে চন্দ্রাবলীর নবরাগে। ছিল পূর্বের যে পূর্বরাগ, আবার একি অপূর্ব রাগ, পাছে রাগে শ্যাম রাধার আদর ভুলে যায়॥ যার মানের মানে আমায় মানে, সে না মানে তবে কি করবে এ মানে। মাধবের কত মান না হয় তার পরিমাণ, মানিনী হয়েছি যার মানে॥ যে পক্ষে যখন বাড়ে অভিমান, সেই পক্ষে রাখতে হয় সম্মান। রাখতে শ্যামের মান, গেল গেল মান, আমার কিসের মান-অপমান॥
ঋতুতে ঋতুতে যে ভেদ সে কেবল বর্ণের ভেদ নহে, বৃত্তিরও ভেদ বটে। মাঝে মাঝে বর্ণসংকর দেখা দেয়--জ্যৈষ্ঠের পিঙ্গল জটা শ্রাবণের মেঘস্তূপে নীল হইয়া উঠে, ফাল্গুনের শ্যামলতায় বৃদ্ধ পৌষ আপনার পীত রেখা পুনরায় চালাইবার চেষ্টা করে। কিন্তু প্রকৃতির ধর্মরাজ্যে এ সমস্ত বিপর্যয় টেঁকে না। গ্রীষ্মকে ব্রাহ্মণ বলা যাইতে পারে। সমস্ত রসবাহুল্য দমন করিয়া, জঞ্জাল মারিয়া তপস্যার আগুন জ্বালিয়া সে নিবৃত্তিমার্গের মন্ত্রসাধন করে। সাবিত্রী-মন্ত্র জপ করিতে করিতে কখনো বা সে নিশ্বাস ধারণ করিয়া রাখে, তখন গুমটে গাছের পাতা নড়ে না; আবার যখন সে রুদ্ধ নিশ্বাস ছাড়িয়া দেয় তখন পৃথিবী কাঁপিয়া উঠে। ইহার আহারের আয়োজনটা প্রধানত ফলাহার।
কবি টেনিসনের পুত্র তাঁহার পরলোকগত পিতার চিঠিপত্র ও জীবনী বৃহৎ দুইখণ্ড পুস্তকে প্রকাশ করিয়াছেন। প্রাচীন কবিদের জীবনের বিস্তৃত বিবরণ খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। তখন জীবনীর শখ লোকের ছিল না; তাহা ছাড়া তখন বড়ো-ছোটো সকল লোকেই এখনকার চেয়ে অপ্রকাশ্যে বাস করিত। চিঠিপত্র, খবরের কাগজ, সভাসমিতি, সাহিত্যের বাদবিরোধ এমন প্রবল ছিল না। সুতরাং প্রতিভাশালী ব্যক্তির জীবনব্যাপারকে নানা দিক হইতে প্রতিফলিত দেখিবার সুযোগ তখন ঘটিত না।