হ্মাত্রে নামক বোম্বাই শিল্পবিদ্যালয়ের একটি দরিদ্র ছাত্র প্যারিস-প্লাস্টারের এক নারীমূর্তি রচনা করিয়াছেন; তাহার নাম দিয়াছেন মন্দিরাভিমুখে (To the Temple)। এই ব্যাপারটুকু লইয়া ইংরাজিপত্রে একটি ছোটোখাটো রকমের দ্বন্দ্বযুদ্ধ হইয়া গেছে। স্যর জর্জ বার্ড্বুড্ সাহেবের নিকট এই মূর্তির দুখানি ফোটোগ্রাফ পাঠানো হয়। ফোটোগ্রাফ দেখিয়া তিনি তাঁহার "জর্নাল অফ ইন্ডিয়ান আর্টসঅ্যান্ড ইন্ডস্ট্রিজ' নামক শিল্পবিষয়ক পত্রে মুক্তকণ্ঠে প্রশংসা করিয়া এক সমালোচনা লিখিয়াছিলেন। তাহাতে তিনি মূর্তিটিকে প্রসিদ্ধ প্রাচীন গ্রীসীয় মূর্তি-সকলের সহিত তুলনীয় বলিয়া স্বীকার করিয়াছিলেন।হয়তো সহৃদয় বার্ড্বুড্ সাহেব তাঁহার ভারতবৎসলতা ও ভারতীয় শিল্পকলার ভাবী উন্নতি কল্পনার আবেগদ্বারা নীত হইয়া এই মূর্তি সম্বন্ধে কিছু অধিক বলিয়াছিলেন, সে কথা বিচার করা আমাদের সাধ্য নহে। পরিক্ষীণঃ কশ্চিৎ স্পৃহয়তি যবানাং প্রসৃতয়ে স পশ্চাৎ সংপূর্ণঃ কলয়তি ধরিত্রীং তৃণসমাম। অতশ্চানৈকান্ত্যদি গুরুলঘুতয়ার্থেষু, ধনিনাম্ অবস্থা বস্তূনি প্রথয়তি চ সংকোচয়তি চ॥
দেশভেদে জলবায়ু ও প্রাকৃতিক অবস্থার প্রভেদ হইয়া থাকে, এ কথা সকলেই জানেন। সেই ভেদকে স্বীকার না করিলে কাজ চলে না। যাহারা বিলখালের মধ্যে থাকে তাহারা মৎস্যব্যবসায়ী হইয়া উঠে; যাহারা সমুদ্রতীরের বন্দরে থাকে তাহারা দেশবিদেশের সহিত বাণিজ্যে প্রবৃত্ত হয়; যাহারা সমতল উর্বরা ভূমিতে বাস করে তাহারা কৃষিকে উপজীবিকা করিয়া তোলে। মরুপ্রায় দেশে যে আরব বাস করে তাহাকে যদি অন্যদেশবাসীর ইতিহাস শুনাইয়া বলা যায় যে কৃষির সাহায্য ব্যতীত উন্নতিলাভ করা যায় না তবে সে উপদেশ ব্যর্থ হয় এবং কৃষিযোগ্য স্থানের অধিবাসীর নিকট যদি প্রমাণ করিতে বসা যায় যে মৃগয়া এবং পশুপালনেই সাহস ও বীর্যের চর্চা হইতে পারে, কৃষিতে তাহা নষ্টই হয়, তবে সেরূপ নিষ্ফল উত্তেজনা কেবল অনিষ্টই ঘটায়। বস্তুত, ভিন্ন পথ দিয়া ভিন্ন জাতি ভিন্ন শ্রেণীর উৎকর্ষ লাভ করে এবং সমগ্র মানুষের সর্বাঙ্গীণ উন্নতিলাভের এই একমাত্র উপায়। য়ুরোপ কতকগুলি প্রাকৃতিক সুবিধাবশত যে বিশেষপ্রকারের উন্নতির অধিকারী হইয়াছে আমরা যদি ঠিক সেইপ্রকার উন্নতির জন্য ব্যাকুল হইয়া উঠি তবে, নিজেকে ব্যর্থ ও বিশ্বমানবকে বঞ্চিত করিব। কারণ, আমাদের দেশের বিশেষ প্রকৃতি অনুসারে আমরা মনুষ্যত্বের যে উৎকর্ষ লাভ করিতে পারি, পরের বৃথা অনুকরণ-চেষ্টায় তাহাকে নষ্ট করিলে এমন একটা জিনিসকে নষ্ট করা হয় যাহা মানুষ অন্য কোনো স্থান হইতে পাইতে পারে না। সুতরাং, বিশ্বমানব সেই অংশে দরিদ্র হয়। চাষের জমিকে খনির মতো ব্যবহার করিলে ও খনিজের জমিকে কৃষিক্ষেত্রের কাজে লাগাইলে মানবসভ্যতাকে ফাঁকি দেওয়া হয়।
অর্থাৎ ভারত দুঃখ নিবারণ সভা। সভার নাম হইতেই তাহার উদ্দেশ্য অনুমান করিয়া লওয়া যাইতে পারে। এই সভাটি গোপনে স্থাপিত হইয়া কিছুকাল হইতে ভারতবর্ষের হিতোদ্দেশে নানা কার্যে হস্তক্ষেপ করিয়া আসিতেছে। সভা যে পরিমাণে কাজ করিয়াছে সে পরিমাণে আপন নাম ঘোষণা করে নাই। ইহাতে আমাদের মনে যথেষ্ট আশার সঞ্চার হয়। সাধারণত আমাদের দেশের রাজনৈতিক সভাসকল কী কী উদ্দেশ্য এবং উপায় অবলম্বন করিয়া থাকে তাহা সকলেই অবগত আছেন। এ সভারও সে-সকল অঙ্গের কোনো ত্রুটি নাই। কিন্তু তাহা ছাড়া ইহার একটি বিশেষত্ব আছে। এ সভা উপযুক্ত বোধ করিলে লোকবিশেষ এবং সম্প্রদায়বিশেষের পক্ষ অবলম্বন করিয়া তাহাদের দুঃখ দূর করিবার জন্য চেষ্টা করিয়া থাকে। কারণ, সভার মতে, ভারতবর্ষকে যেমন অনুচিত আইন হইতে রক্ষা করা চাই, তেমনি তাহাকে অন্যায় শাসন হইতেও পরিত্রাণ করা আবশ্যক।