এ কবিতাগুলিও তোমাকে দিলাম। বহুকাল হইল, তোমার কাছে বসিয়াই লিখিতাম, তোমাকেই শুনাইতাম। সেই সমস্ত স্নেহের স্মৃতি ইহাদের মধ্যে বিরাজ করিতেছে। তাই, মনে হইতেছে তুমি যেখানেই থাক না কেন, এ লেখাগুলি তোমার চোখে পড়িবেই।
কেনই বা থাকিবে ? তিনি নিজের কাছে নিজে সর্ব্বদাই সম্ভ্রমে নত হইয়া থাকেন । তাঁহার নিজের সহচর নিজেই । অত বড় সহচর দশের মধ্যে কোথায় মিলিবে ! প্রতিভা যখন মুহূর্ত্ত কালের জন্য অতিথি হইয়া এক জন কবিকে বীণা করিয়া তাঁহার তন্ত্রী হইতে সুর বাহির করিতে থাকে তখন তিনি নিজের সুর শুনিয়া নিজে মুগ্ধ হইয়া পড়েন । বাল্মীকি তাঁহার নিজের রচিত রামকে যেমন ভক্তি করিতেন এমন কোন ভক্ত করেন না এবং যতক্ষন তিনি রামের চরিত্র সৃজন করিতেছিলেন ততক্ষন তিনি নিজেই রাম হইয়াছিলেন ও তাঁহার নিজের মহান ভাবে নিজেই মোহিত হইয়া গিয়াছিলেন । এইরূপে যাঁহারা নিজেকে নিজেই ভক্তি করিতে পারেন, নিজের সাহচর্য্যে নিজে সুখ ভোগ করিতে পারেন, তাঁহাদিগকে আর দশ জনের হস্তে আত্মসমর্পণ করিতে হয় না । এক কথায় -- যাঁহারা একলা থাকেন তাঁহারা আর পরের সহিত মিশিবার অবসর পান না । ইহাকেই বলে অহঙ্কারবিবর্জ্জিত আত্মম্ভরিতা ।
একলা একজন মাত্র লোক কিছুই নহে। সে ব্যক্তিই নহে! সে, সাধারণ মনুষ্য সমাজের সম্পত্তি। শ্যামের সঙ্গেও তাহার যে সম্পর্ক, রামের সঙ্গেও তাহার সেই সম্পর্ক। সে সরকারী। সে অমিশ্র জলজনন বাষ্পের মত। যতক্ষণ জলজনন বাষ্প অমিশ্র ভাবে থাকে, ততক্ষণ বায়ুর সঙ্গেও তাহার যে সম্পর্ক, জলের সঙ্গেও তাহার সেই সম্পর্ক। অবশেষে আর গুটি দুই তিন বাষ্প আসিয়া যখন তাহার সঙ্গে মেলে, তখন আমরা স্থির করিয়া বলিতে পারি সে জল কি বায়ু। তেমনি একক আমার সহিত যখন আর গুটি দুই তিন ব্যক্তি আসিয়া জমা হয়, তখন আমি ব্যক্তিবিশেষ হইয়া দাঁড়াই। আমার বন্ধু বান্ধব আত্মীয়গণ আমার সীমা। সাধারণ মনুষ্যদের হইতে আমাকে পৃথক্ করিয়া রাখা, আমাকে ব্যক্তিবিশেষ করিয়া রাখাই তাঁহাদের কাজ। অতএব দেখা যাইতেছে আমাদের চারি দিকে কতকগুলি বিশেষ পরের আবশ্যক, সাধারণ পর হইতে তাহারা আমাদিগকে পর করিয়া রাখে। কতকগুলি পরকে আপনার করিতে না পারিলে আমি "আপনি" হইতে পারি না; "পর" দিয়া "আপনি" কে গড়িয়া তুলিতে হয়। নহিলে আমি মানুষ হই, ব্যক্তি হই না। আত্মীয় বন্ধু বান্ধব -নামক কতকগুলি পর আছেন, তাঁহারা পরকে পর করেন, আপনাকে আপনি রাখেন। আমাদের কেহই যদি আত্মীয় না থাকিত, তাহা হইলে আমাদের পরই বা কে থাকিত? তাহা হইলে সকলেরই সঙ্গে আমার সমান সম্পর্ক থাকিত। রেখাব-নামক একটি সুর যতক্ষণ স্বতন্ত্র থাকে ততক্ষণ সে বেহাগেরও যেমন সম্পত্তি কানেড়ারও তেমনি সম্পত্তি ও অমন শত সহস্র রাগিণীর সঙ্গে তাহার সমান যোগ। কিন্তু যেই তার চতুষ্পার্শ্বে আর কতকগুলি সুর আসিয়া একত্র হয় তখনি সে বিশেষ রাগিনী হইয়া দাঁড়ায় ও অবশিষ্ট সমুদায় রাগিনীকে পর বলিয়া গণ্য করে। তেমনি আমরা যে সকলে রেখাব গান্ধার প্রভৃতি একেকটি সুর না হইয়া বেহাগ ভৈরবী প্রভৃতি একেকটি রাগিনী হইয়াছি, তাহা কেবল আমাদের আত্মীয় বন্ধু বান্ধবের প্রসাদে। আমরা যে একলা থাকিতে পাই, বিরলে থাকিতে পারি, তাহার কারণ আমাদের বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়গণ আমাদিগকে চারি দিকে ঘেরিয়া রাখিয়াছেন বলিয়া। নতুবা আমরা মুক্ত জগতে লক্ষ লোকের মধ্যে গিয়া পড়িতাম, শতসহস্রের কোলাহলের মধ্যে আমাদিগকে বাস করিতে হইত। অতএব কতকগুলি লোক ঘনিষ্ঠ ভাবে আমাদের কাছাকাছি না থাকিলে আমরা একলা থাকিতে পাই না, বিরলে থাকিতে পারি না। আকারহীন, ভাষাহীন, অন্তঃপুরহীন, কুহেলিকাময় কতকগুলা অপরিস্ফুট ভাবের দল আমাদের মনের মধ্যে যেমন ঘেঁষাঘেঁষি করিয়া আনাগোনা করে, পরস্পরের কোলাহলে পরস্পর মিশাইয়া থাকে, সমাজের মধ্যে আমরা তেমনি থাকি। অবশেষে সে ভাবগুলিকে যখন বিযুক্ত করিয়া লইয়া তাহাদিগকে আকার দিয়া, ভাষাবদ্ধ করিয়া, তাহাদের জন্য এক একটা স্বতন্ত্র অন্তঃপুর স্থাপন করিয়া দিই, তখন তাহারা যেমন বিরলে থাকে, একক হইয়া যায়, আমরা সংসারী হইয়া তেমনি হই।
উপরের কথাটাকে আরো একটু বিস্তৃত করা যাক । একজন লোক মরিয়া গেল,আমরা সাধারণতঃ মনে করি সেই গেল , তাহার সহিত আর কিছু গেল না । এরূপ ভ্রমে পড়িবার প্রধান কারণ এই যে, আমরা সচরাচর মনে করি যে,সেও যে জগতে আছে আমরাও সেই জগতে আছি,সেও যাহা দেখিতেছে আমরাও তাহাই দেখিতেছি । কিন্তু সেই অনুমানটাই ভ্রম নাকি, এই নিমিত্ত সমস্ত যুক্তিতে ভ্রম পৌঁছিয়াছে । সে যাহা দেখিতেছে আমরা তাহা দেখিতেছি না, সে যেখানে আছে আমরা সেখানে নাই । সে দেখিতেছে, ভাগীরথী পতিমিলনাশয়ে চঞ্চলা যুবতীর ন্যায় নৃত্য করিতেছে,গান গাহিতেছে; আমি দেখিতেছি ভাগীরথী স্নেহময়ী মাতার ন্যায় তটভূমিকে স্তন্যপান করাইতেছেন, তরঙ্গহস্তে অনবরত তাহার ললাটে অভিঘাত করিয়া কলকন্ঠে বৈচিত্র্যহীন ঘুম পাড়াইবার গান গাহিতেছেন । উভয় জগতের উভয় জাহ্নবীর মধ্যে এত প্রভেদ । এই প্রকার , যত লোক আছে সকল লোকেরই জগৎ স্বতন্ত্র। লোক অর্থে, মনুষ্যবিশেষ এবং লোক অর্থে জগৎ বুঝায় । অর্থাৎ একজন মনুষ্য বলিলে একটি জগৎ বলা হয়। আমি কে ? না, আমি যাহা কিছু দেখিতেছি -- চন্দ্র সূর্য্য পৃথিবী ইত্যাদি -- সমস্ত লইয়া একজন । তুমিও তাহাই । অতএব প্রতি লোকের সঙ্গে সঙ্গে শত শত চন্দ্র সূর্য্য জন্মগ্রহণ করে ও শত শত চন্দ্র সূর্য্য মরিয়া যায় । অতএব দেখ, জগৎ যেমন অসংখ্য তেমনি বিচিত্র । কাহারো জগতে সূর্য্যোদয় আছে, আঁধারের অপগমন ও আলোকের আগমন আছে, কিন্তু প্রভাত নাই । সে ব্যক্তি সূর্য্যোদয়-রূপ একটা ঘটনা দেখিতে পায় বটে, কিন্তু প্রভাত দেখিতে পায় না। প্রভাতশিশির, প্রভাতসমীরণ, প্রভাতমেঘমালা,প্রভাত-অরুণরাগের সামঞ্জস্য দেখিতে পায় না; সুতরাং তাহার জগতে প্রভাত ব্যতীত প্রভাতের আর সমস্তই আছে । কাহারো বা প্রভাত আছে,সন্ধ্যা নাই । বসন্ত আছে,শরৎ নাই । কাহারো জ্যোৎস্না হাসে, কাহারো জ্যোৎস্না কাঁদে । কাহারো জগতে টাকার ঝম্ঝম্ ব্যতীত সঙ্গীত নাই, মলের ঝম্ঝম্ ব্যতীত কবিতা নাই, উদরের বাহিরে সুখ নাই, ইন্দ্রিয়ের বাহিরে অস্তিত্ব নাই । এমন কত কহিব ! এ সকল ত স্পষ্ট প্রভেদ; সূক্ষ প্রভেদ কত আছে, তাহার নাম কে করিবে?