এ কবিতাগুলিও তোমাকে দিলাম। বহুকাল হইল, তোমার কাছে বসিয়াই লিখিতাম, তোমাকেই শুনাইতাম। সেই সমস্ত স্নেহের স্মৃতি ইহাদের মধ্যে বিরাজ করিতেছে। তাই, মনে হইতেছে তুমি যেখানেই থাক না কেন, এ লেখাগুলি তোমার চোখে পড়িবেই।
আমি দেখিতেছি মহিলারা রাগ করিতেছেন, অতএব স্ত্রৈণ কাহাকে বলে তাহার একটা মীমাংসা করা আবশ্যক বিবেচনা করিতেছি| এই কথাটা সকলেই ব্যবহার করেন, কিন্তু ইহার অর্থ অতি অল্প লোকেই সর্ব্বতোভাবে বুঝেন। যে ব্যক্তি স্ত্রীকে কিছু বিশেষরূপ ভালবাসে সাধারণতঃ লোকে তাহাকেই স্ত্রৈণ বলে। কিন্তু বাস্তবিক স্ত্রৈণ কে? না, যে ব্যক্তি স্ত্রীকে আশ্রয় দিতে পারে না,স্ত্রীর উপর নির্ভর করে। বলিষ্ঠ পুরুষ হইয়াও অবলা নারীকে ঠেসান দিয়া থাকে! যে ব্যক্তি পড়িয়া গেলে স্ত্রীকে ধরিয়া উঠে, মরিয়া গেলে স্ত্রীকে লইয়া মরে; যে ব্যক্তি সম্পদের সময় স্ত্রীকে পশ্চাতে রাখে ও বিপদের সময় স্ত্রীকে সম্মুখে ধরে; এক কথায় যে ব্যক্তি "আত্মানং সততং রক্ষেৎ দারৈরপি ধনৈরপি" ইহাই সার বুঝিয়াছে, সেই স্ত্রৈণ। অর্থাৎ ইহারা সমস্তই উল্টাপাল্টা করে। ইংরাজ জাতিরা স্ত্রৈণের ঠিক বিপরীত। কারণ, তাহারা স্ত্রীকে হাত ধরিয়া গাড়িতে উঠাইয়া দেয়, স্ত্রীর মুখে আহার তুলিয়া দেয়, স্ত্রীকে ছাতা ধরে ইত্যাদি। তাহারা স্ত্রীলোকদিগকে এতই দুর্ব্বল মনে করে যে, সকল বিষয়েই তাহাদিগকে সাহায্য করে। ইহাদিগকে দেখিয়া স্ত্রৈণ জাতি মুখে কাপড় দিয়া হাসে ও বলে "ইংরাজেরা কি স্ত্রৈণ। কোথায় গর্ম্মি হইলে স্ত্রী সমস্ত রাত জাগিয়া তাহাকে বাতাস দিবে, না, সে স্ত্রীকে বাতাস দেয়! কোথায় যতক্ষণ না বলিষ্ঠ পুরুষদের তৃপ্তিপূর্ব্বক আহার নিঃশেষ হয় ততক্ষণ অবলা জাতিরা উপবাস করিয়া থাকিবে, না, বলীয়ান্ পুরুষ হইয়া অবলার মুখে আহার তুলিয়া দেয়! ছি ছি, কি লজ্জা! এমন যদি হইল তবে আর বল কিসের জন্য!"
মুখস্থ করাইয়া শিক্ষা দেওয়া এই গ্রন্থের উদ্দেশ্য নহে। শব্দ ও বাক্যগুলি নানা প্রকারে বারবার ব্যবহারের দ্বারা ছাত্রদের শিক্ষা অগ্রসর হইতে থাকিবে ইহাই লেখকের অভিপ্রায়। শব্দগুলি বোর্ডে লিখিত থাকিবে, ছাত্ররা তাহাই দেখিয়া মুখে ও লেখায় বাক্যরচনা অভ্যাস করিবে। এই গ্রন্থের পরিশিষ্ট ভাগে অনেকগুলি বিশেষ্য বিশেষণ শব্দ দেওয়া হইয়াছে, সর্বদা ব্যবহার্য শব্দ-শিক্ষায় ও বাক্যরচনা-চর্চায় সেগুলি কাজে লাগিবে। যে রীতি অনুসরণ করিয়া লেখক একদা কোনো ছাত্রকে অল্পকালের মধ্যে অনেকটা পরিমাণে ইংরেজি শিখাইতে পারিয়াছিলেন এই গ্রন্থে সেই রীতি অবলম্বন করা হইয়াছে।
কত অসংখ্য কত বিচিত্র জগৎ আছে,তাহা একবার মনোযোগ-পূর্ব্বক ভাবিয়া দেখা হউক দেখি ! আমার কথা হয়ত অনেকে ভূল বুঝিতেছেন। অনেকে হয়ত চন্দ্র সূর্য্য গ্রহ নক্ষত্র একটি একটি গণনা করিয়া জগতের সংখ্যা নিরূপণ করিতেছেন। কিন্তু আমি আর এক দিক হইতে গণনা করিতেছি। জগৎ একটি বই নয়। কিন্তু প্রতি লোকের এক একটি যে পৃথক জগৎ আছে, তাহাই গননা করিয়া দেখ দেখি! কত সহস্র জগৎ! আমি যখন রোগযন্ত্রণায় কাতর হইয়া ছট্ফট্ করিতেছি তখন কেন জ্যোৎস্নার মুখ ম্লান হইয়া যায়, উষার মুখেও শ্রান্তি প্রকাশ পায়,সন্ধ্যার হৃদয়েও অশান্তি বিরাজ করিতে থাকে? অথচ সেই মুহূর্ত্তে কত শত লোকের কত শত জগৎ আনন্দে হাসিতেছে! কত শত ভাবে তরঙ্গিত হইতেছে! না হইবে কেন? আমার জগৎ যতই প্রকান্ড, যতই মহান হউক না কেন, "আমি" বলিয়া একটি ক্ষুদ্র বালুকণার উপর তাহার সমস্তটা গঠিত। আমার সহিত সে জন্মিয়াছে,আমার সহিত সে লয় পাইবে। সুতরাং আমি কাঁদিলেই সে কাঁদে,আমি হাসিলেই সে হাসে। তাহার আর কাহাকেও দেখিবার নাই, আর কাহারও জন্য ভাবিবার নাই। তাহার লক্ষ তারা আছে,কেবল আমার মুখের দিকে চাহিয়া থাকিবার জন্য। এক জন লোক যখন মরিয়া গেল,তখন আমরা ভাবি না যে একটি জগৎ নিভিয়া গেল। একটি নীলাকাশ গেল, একটি সৌর-পরিবার গেল, একটি তরুলতাপশুপক্ষী-শোভিত পৃথিবী গেল।