কালমৃগয়া (kalmrigoya)
প্রথম দৃশ্য
তপোবন
[ঋষিকুমারের প্রবেশ]
মিশ্র ভূপালী -- যৎ
বেলা যে চলে যায়, ডুবিল রবি।
ছায়ায় ঢেকেছে ঘন অটবী।
কোথা সে লীলা গেল কোথায়!
লীলা লীলা, খেলাবি আয়।
[লীলার প্রবেশ]
মিশ্র খাম্বাজ--কাওয়ালি
লীলা।
ও ভাই, দেখে যা,
কত ফুল তুলেছি!
ঋষিকুমার।
তুই আয় রে কাছে আয়,
আমি তোরে সাজিয়ে দি!
তোর হাতে মৃণাল-বালা,
তোর কানে চাঁপার দুল।
তোর মাথায় বেলের সিঁথি,
তোর খোঁপায় বকুল ফুল!
মিশ্র খাম্বাজ -- আড়খেমটা
লীলা।
ও দেখবি রে ভাই, আয় রে ছুটে,
মোদের বকুল গাছে
রাশি রাশি হাসির মত
ফুল কত ফুটেছে।
কত গাছের তলায় ছড়াছড়ি
গড়াগড়ি যায়_
ও ভাই, সাবধানেতে আয় রে হেথা,
দিস নে দ'লে পায়!
মিশ্র বিভাস--আড়খেমটা
লীলা।
কাল সকালে উঠব মোরা
যাব নদীর কূলে_
শিব গড়িয়ে করব পুজো,
আনব কুসুম তুলে।
ঋষিকুমার।
মোরা ভোরের বেলা গাঁথব মালা,
দুলব সে দোলায়,
বাজিয়ে বাঁশি গান গাহিব
বকুলের তলায়।
লীলা।
না ভাই, কাল সকালে মায়ের কাছে
নিয়ে যাব ধ'রে,
মা বলেছে ঋষির সাজে
সাজিয়ে দেবে তোরে!
ঋষিকুমার।
সন্ধ্যা হয়ে এল যে ভাই,
এখন যাই ফিরে_
একলা আছেন অন্ধ পিতা
আঁধার কুটীরে।
দ্বিতীয় দৃশ্য
বন
বনদেবীগণ
মিশ্র সিন্ধু--ঢিমে তেতালা
প্রথম।
সমুখেতে বহিছে তটিনী,
দুটি তারা আকাশে ফুটিয়া,
দ্বিতীয়।
বায়ু বহে পরিমল লুটিয়া।
তৃতীয়।
সাঁঝের অধর হতে
ম্লান হাসি পড়িছে টুটিয়া।
চতুর্থ।
দিবস বিদায় চাহে,
সরযূ বিলাপ গাহে,
সায়াহ্নেরি রাঙা পায়ে,
কেঁদে কেঁদে পড়িছে লুটিয়া!
সকলে।
এস সবে এস সখি,
মোরা হেথা ব'সে থাকি।
প্রথম।
আকাশের পানে চেয়ে
জলদের খেলা দেখি!
সকলে।
আঁখি-'পরে তারাগুলি
একে একে উঠিবে ফুটিয়া।
রাগিণী মিশ্র কেদারা--একতালা
সকলে।
ফুলে ফুলে ঢ'লে ঢ'লে বহে কিবা মৃদু বায়,
তটিনী হিল্লোল তুলে কল্লোলে চলিয়া যায়
পিক কিবা কুঞ্জে কুঞ্জে কুহূ কুহূ কুহূ গায়,
কি জানি কিসেরি লাগি প্রাণ করে হায় হায়!
ছায়ানট--আধ্বা
প্রথম।
নেহার' লো সহচরি,
কানন আঁধার করি,
ওই দেখ বিভাবরী আসিছে।
দ্বিতীয়।
দিগন্ত ছাইয়া
শ্যাম মেঘরাশি থরে থরে ভাসিছে।
তৃতীয়।
আয়, সখি, এই বেলা
মাধবী মালতী বেলা
রাশি রাশি ফুটাইয়ে কানন করি আলা।
চতুর্থ।
ওই দেখ নলিনী উথলিত সরসে।
অফুট-মুকুল-মুখী মৃদু মৃদু হাসিছে।
সকলে।
আসিবে ঋষিকুমার কুসুমচয়নে,
ফুটায়ে রাখিয়া দিব তারি তরে সযতনে।
নিচু নিচু শাখাতে ফোটে যেন ফুলগুলি,
কচি হাত বাড়াইয়ে পায় যেন কাছে!
তৃতীয় দৃশ্য
কুটীর
অন্ধ ঋষি ও ঋষিকুমার
বেদপাঠ
অন্তরিক্ষোদরঃ কোশো ভূমিবুধ্নো ন জীর্য্যতি দিশো হস্য স্রক্তয়ো দ্যৌরস্যোত্তরং বিলং স এষ কোশোবসুধানস্তস্মিন্ বিশ্বমিদং শ্রিতম্॥
তস্য প্রাচী দিগ্ জুহূর্নাম সহমানা নাম দক্ষিণা রাজ্ঞী নাম প্রতীচী সুভূতা নামোদীচী তাসাং বায়ুর্ব্বৎসঃ স য এতমেবং দিশাং বৎসং বেদ ন পুত্র রোদং রোদিতি সোহহমেতমেবং বায়ুং দিশাং বৎসং বেদ মা পুত্ররোদং রুদম্॥
জয়জয়ন্তী--ঝাঁপতাল
অন্ধ ঋষি।
জল এনে দে রে বাছা তৃষিত কাতরে।
শুকায়েছে কণ্ঠ তালু, কথা নাহি সরে।
[মেঘগর্জ্জন]
দেশ-- ঢিমে তেতালা
না না কাজ নাই, যেও না বাছা,--
গভীরা রজনী, ঘোর ঘন গরজে,
তুই যে এ অন্ধের নয়নতারা।
আর কে আমার আছে!
কেহ নাই, কেহ নাই--
তুই শুধু রয়েছিস হৃদয় জুড়ায়ে--
তোরেও কি হারাব বাছা রে,
সে ত প্রাণে স'বে না!
খাম্বাজ--ঢিলে তেতালা
ঋষিকুমার।
আমা-তরে অকারণে, ওগো পিতা, ভেবো না।
অদূরে সরযূ বহে, দূরে যাব না।
পথ যে সরল অতি,
চপলা দিতেছে জ্যোতি,
তবে কেন, পিতা, মিছে ভাবনা।
অদূরে সরযূ বহে, দূরে যাব না।
[প্রস্থান
চতুর্থ দৃশ্য
বন
বনদেবতা
গৌড়মল্লার--কাওয়ালি
সঘন ঘন ছাইল গগন ঘনাইয়া,
স্তিমিত দশ দিশি,
স্তম্ভিত কানন,
সব চরাচর আকুল--
কি হবে কে জানে,
ঘোরা রজনী,
দিক-ললনা ভয়বিভলা।
চমকে চমকে সহসা দিক উজলি
চকিতে চকিতে মাতি ছুটিল বিজলী
থরহর চরাচর পলকে ঝলকিয়ে।
ঘোর তিমির ছায় গগন মেদিনী,
গুরু গুরু নীরদগরজনে
স্তব্ধ আঁধার ঘুমাইছে--
সহসা উঠিল জেগে প্রচণ্ড সমীরণ,
কড় কড় বাজ!
[প্রস্থান
[বনদেবীগণের প্রবেশ]
মল্লার--কাওয়ালি
সকলে।
ঝম্ ঝম্ ঘন ঘন রে বরষে।
দ্বিতীয়।
গগনে ঘনঘটা, শিহরে তরু লতা--
তৃতীয়।
ময়ূর ময়ূরী নাচিছে হরষে!
সকলে।
দিশি দিশি সচকিত, দামিনী চমকিত--
প্রথম।
চমকি উঠিছে হরিণী তরাসে!
মল্লার--কাওয়ালি
সকলে।
আয় লো সজনি, সবে মিলে!
ঝর ঝর বারিধারা,
মৃদু মৃদু গুরু গুরু গর্জ্জন,
এ বরষা-দিনে,
হাতে হাতে ধরি ধরি
গাব মোরা লতিকাদোলায় দুলে!
প্রথম।
ফুটাব যতনে কেতকী কদম্ব অগণন।
দ্বিতীয়।
মাখাব বরণ ফুলে ফুলে।
তৃতীয়।
পিয়াব নবীন সলিল, পিয়াসিত তরুলতা--
চতুর্থ।
লতিকা বাঁধিব গাছে তুলে।
প্রথম।
বনেরে সাজায়ে দিব, গাঁথিব মুকুতাকণা
পল্লবশ্যাম-দুকূলে।
দ্বিতীয়।
নাচিব, সখি, সবে নবঘন-উৎসবে
বিকচ বকুলতরু-মূলে!
[ঋষিকুমারের প্রবেশ]
গারা--কাওয়ালি
ঋষিকুমার।
কি ঘোর নিশীথ, নীরব ধরা!
পথ যে কোথায় দেখা নাহি যায়,
জড়ায়ে যায় চরণে লতাপাতা।
যাই, ত্বরা ক'রে যেতে হবে
সরযূতটিনী-তীরে--
কোথায় সে পথ!
ওই কল কল রব!
আহা, তৃষিত জনক মম,
যাই তবে যাই ত্বরা।
বনদেবীগণ।
এই ঘোর আঁধার, কোথা রে যাস!
ফিরিয়ে যা, তরাসে প্রাণ কাঁপে!
স্নেহের পুতুলি তুই,
কোথা যাবি একা এ নিশীথে!
কি জানি কি হবে, বনে হবি পথহারা!
ঋষিকুমার।
না, কোরো না মানা, যাব ত্বরা।
পিতা আমার কাতর তৃষায়,
যেতেছি তাই সরযূনদীতীরে।
মিশ্র বেলাওল--একতালা
বনদেবীগণ।
মানা না মানিলি, তবুও চলিলি,
কি জানি কি ঘটে!
অমঙ্গল হেন প্রাণে জাগে কেন,
থেকে থেকে যেন প্রাণ কেঁদে ওঠে!
রাখ্ রে কথা রাখ্, বারি আনা থাক্,
যা ঘরে যা ছুটে!
অয়ি দিগঙ্গনে, রেখো গো যতনে
অভয়স্নেহছায়ায়!
অয়ি বিভাবরী, রাখ বুকে ধরি
ভয় অপহরি রাখ এ জনায়!
এ যে শিশুমতি, বন ঘোর অতি--
এ যে একেলা অসহায়!
পঞ্চম দৃশ্য
[শিকারীগণের প্রবেশ]
ইমন কল্যাণ--কাওয়ালি
বনে বনে সবে মিলে চল হো! চল হো!
ছুটে আয়, শিকারে কে রে যাবি আয়!
এমন রজনী বহে যায় রে!
ধনু বাণ বল্লম লয়ে হাতে
আয়, আয়, আয়, আয় রে!
বাজা শিঙ্গা ঘন ঘন--
শব্দে কাঁপিবে বন,
আকাশ ফেটে যাবে,
চমকিবে পশু পাখী সবে,
ছুটে যাবে কাননে কাননে--
চারি দিক ঘিরে যাব পিছে পিছে
হোঃ হোঃ হোঃ হোঃ!
[দশরথের প্রবেশ]
সিন্দুড়া
শিকারীগণ।
জয়তি জয় জয় রাজন্ বন্দি তোমারে,
কে আছে তোমা সমান।
ত্রিভুবন কাঁপে তোমার প্রতাপে,
তোমারে করি প্রণাম!
দশরথ।
[শিকারীদের প্রতি]
বাহার
গহনে গহনে যা রে তোরা,
নিশি ব'হে যায় যে!
তন্ন তন্ন করি অরণ্য
করী বরাহ খোঁজ্ গে!
এই বেলা যা রে!
নিশাচর পশু সবে
এখনি বাহির হবে--
ধনুর্ব্বাণ নে রে হাতে, চল্ ত্বরা চল্।
জ্বালায়ে মশাল আলো
এই বেলা আয় রে!
[প্রস্থান
অহং--কাওয়ালি
প্রথম শিকারী।
চল চল, ভাই,
ত্বরা ক'রে মোরা আগে যাই।
দ্বিতীয়।
প্রাণপণ খোঁজ্ এ বন, সে বন।
তৃতীয়।
চল্ মোরা ক'জন ও দিকে যাই।
প্রথম।
না না ভাই, কাজ নাই,
হোথা কিছু নাই-- কিছু নাই--
ওই ঝোপে যদি কিছু পাই।
তৃতীয়।
বরা'! বরা'!
প্রথম।
আরে দাঁড়া দাঁড়া,
অত ব্যস্ত হ'লে ফস্কাবে শিকার।
চুপিচুপি আয়, চুপিচুপি আয়
অশথতলায়--
এবার ঠিক্ঠাক্ হয়ে সবে থাক্--
সাবধান, ধর বাণ, সাবধান, ছাড় বাণ--
২। ৩ জন।
গেল গেল ওই ওই পালায় পালায়--
চল্ চল্--
ছোট্ রে পিছে, আয় রে ত্বরা যাই।
[প্রস্থান
[বিদূষকের সভয়ে প্রবেশ]
দেশ--খেমটা
প্রাণ নিয়ে ত সট্কেছি রে,
ওরে বরা, করবি এখন কি!
বাবা রে!
আমি চুপ ক'রে এই
আমড়াতলায় লুকিয়ে থাকি।
এই মরদের মুরদখানা,
দেখেও কি রে ভড়্কালি না--
বাহাবা, সাবাস তোরে,
সাবাস্ রে তোর ভরসা দেখি।
গরীব ব্রাহ্মণের ছেলে
ব্রাহ্মণীরে ঘরে ফেলে
কোথা এলেম এ ঘোর বনে!
মনে আশা ছিল মস্ত
চলবে ভাল দক্ষিণ হস্ত--
হা রে রে পোড়া কপাল,
তাও যে দেখি কেবল ফাঁকি!
[শিকারীগণের প্রবেশ]
শঙ্করা
শিকারীগণ।
ঠাকুরমশয়, দেরি না সয়--
তোমার আশায় সবাই ব'সে।
শিকারেতে হবে যেতে,
মিহি কোমর বাঁধ ক'ষে!
বন বাদাড় সব ঘেঁটেঘুঁটে,
আমরা মরি খেটেখুটে,
তুমি কেবল লুটেপুটে
পেট পোরাবে ঠেসেঠুসে!
বিদূষক।
কাজ কি খেয়ে, তোফা আছি--
আমায় কেউ না খেলেই বাঁচি!
শিকার করতে যায় কে মরতে--
ঢুঁসিয়ে দেবে বরা' মোষে!
ঢুঁ খেয়ে ত পেট ভরে না,
সাধের পেটটি যাবে ফেঁসে।
[হাসিতে হাসিতে শিকারীগণের প্রস্থান
মিশ্র সিন্ধু
বিদূষক।
আঃ, বেঁচেছি এখন!
শর্ম্মা ও দিকে আর নন।
গোলেমালে ফাঁকতালে সটকেছি কেমন।
বাবা! দেখে বরা'র দাঁতের পাটি
লেগেছিল দাঁত-কপাটি,
পড়ল খ'সে হাতের লাঠি
কে জানে কখন।
চুলগুলা সব ঘাড়ে খাড়া,
চক্ষুদুটো মশাল-পারা,
গোঁ ভরে হেঁট-মুখে তাড়া
কল্লে সে যখন--
রাস্তা দেখতে পাই নে চোখে,
পেটের মধ্যে হাত পা ঢোকে,
চুপসে গেল ফাঁপা ভুঁড়ি
শঙ্কাতে তখন।
[প্রস্থান
[শিকার স্কন্ধে শিকারীগণের প্রবেশ]
এনেছি মোরা এনেছি মোরা
রাশি রাশি শিকার!
করেছি ছারখার,
সব করেছি ছারখার!
বনবাদাড় তোলপাড়,
করেছি রে উজাড়!
[গাইতে গাইতে প্রস্থান
[বনদেবীদের প্রবেশ]
মিশ্র মল্লার--পোস্ত
কে এল আজি এ ঘোর নিশীথে
সাধের কাননে শান্তি নাশিতে।
মত্ত করী যত পদ্মবন দলে
বিমল সরোবর মন্থিয়া,
ঘুমন্ত বিহগে কেন বধে রে
সঘনে খর শর সন্ধিয়া!
তরাসে চমকিয়ে হরিণ হরিণী
স্খলিত চরণে ছুটিছে!
স্খলিত চরণে ছুটিছে কাননে,
করুণনয়নে চাহিছে।
আকুল সরসী, সারস সারসী
শরবনে পশি কাঁদিছে।
তিমির দিগভরি ঘোর যামিনী,
বিপদ ঘনছায়া ছাইয়া।
কি জানি কি হবে, আজি এ নিশীথে,
তরাসে প্রাণ ওঠে কাঁপিয়া!
[প্রস্থান
[দশরথের প্রবেশ]
খাম্বাজ--কাওয়ালি
না জানি কোথা এলুম, এ যে ঘোর বন।
কোথা গেল সে করিশিশু, কোথা লুকাল!
একে ত জটিল বন, তাহে আঁধার ঘন!
যাক্-না যাবে সে কত দূর, কত দূর--
যাব পিছে পিছে--
না না না না, ও কি শুনি!
ওই সে সরযূতীরে করিছে সলিল পান
শবদ শুনি যে ওই, এই তবে ছাড়ি বাণ!
নেপথ্যে বনদেবীগণ
ভৈরবী
হায় কি হ'ল! হায় কি হ'ল!
[বাণাহত ঋষিকুমারের নিকট দশরথের গমন]
বেহাগ-- আড়াঠেকা
কি করিনু হায়!
এ ত নয় রে করিশিশু, ঋষির তনয়!
নিঠুর প্রখর বাণে রুধিরে আপ্লুতকায়
কার রে প্রাণের বাছা ধুলাতে লুটায়!
কি কুলগ্নে না জানি রে ধরিলাম বাণ,
কি মহাপাতকে কার বধিলাম প্রাণ!
দেবতা, অমৃতনীরে হারা-প্রাণ দাও ফিরে,
নিয়ে যাও মায়ের কোলে মায়ের বাছায়!
[মুখে জলসিঞ্চন]
খট--ঝাঁপতাল
ঋষিকুমার।
কি দোষ করেছি তোমার,
কেন গো হানিলে বাণ!
একই বাণে বধিলে যে
দুটি অভাগার প্রাণ!
শিশু বনচারী আমি
কিছুই নাহিক জানি--
ফল মূল তুলে আনি,
করি সামবেদ গান!
জন্মান্ধ জনক মম
তৃষায় কাতর হয়ে
রয়েছেন পথ চেয়ে_
কখন যাব বারি লয়ে।
মরণান্তে নিয়ে যেও,
এ দেহ তাঁর কোলে দিও--
দেখো, দেখো ভুলোনাকো,
কোরো তাঁরে বারিদান!
মার্জ্জনা করিবেন পিতা,
তাঁর যে দয়ার প্রাণ!
[মৃত্যু]
ষষ্ঠ দৃশ্য
কুটীর
অন্ধ ঋষি
মিশ্র ঝিঁঝিট খাম্বাজ--মধ্যমান
অন্ধঋষি।
আমার প্রাণ যে ব্যাকুল হয়েছে--
হা তাত, একবার আয় রে!
ঘোরা রজনী, একাকী
কোথা রহিলে এ সময়ে!
প্রাণ যে চমকে মেঘগরজনে--
কী হবে কে জানে!
[লীলার প্রবেশ]
রামকেলী--কাওয়ালি
বল বল পিতা, কোথা সে গিয়েছে!
কোথা সে ভাইটি মম, কোন্ কাননে!
কেন তাহারে নাহি হেরি!
খেলিবে সকালে আজ বলেছিল সে,
তবু কেন এখন না এল?
বনে বনে ফিরি "ভাই' "ভাই' করিয়ে,
কেন গো সাড়া পাই নে!
বেহাগ--কাওয়ালি
অন্ধ।
কে জানে কোথা সে!
প্রহর গণিয়া গণিয়া বিরলে
তারি লাগি ব'সে আছি!
একা হেথা, কুটীরদুয়ারে--
বাছা রে এলি নে!
ত্বরা আয়, ত্বরা আয়, আয় রে_
জল আনিয়ে কাজ নাই,
তুই যে আমার পিপাসার জল!
কেন রে জাগিছে মনে ভয়!
কেন আজি তোরে,
হারাই হারাই মনে হয়!
কে জানে!
[লীলার প্রস্থান
[মৃতদেহ লইয়া দশরথের প্রবেশ]
সিন্ধু--চৌতাল
অন্ধ।
এতক্ষণে বুঝি এলি রে!
হৃদিমাঝে আয় রে, বাছা রে!
কোথা ছিলি বনে, এ ঘোর রাতে,
এ দুর্য্যোগে, অন্ধ পিতারে ভুলি!
আছি সারানিশি হায় রে
পথ চাহিয়ে, আছি তৃষায় কাতর--
দে মুখে বারি, কাছে আয় রে!
রাজবিজয়ী
দশরথ।
অজ্ঞানে কর হে ক্ষমা, তাত, ধরি চরণে--
কেমনে কহিব, শিহরি আতঙ্কে!
আঁধারে সন্ধানি শর খরতর
করী-ভ্রমে বধি তব পুত্রবর,
গ্রহদোষে পড়েছি পাপপঙ্কে!
[দশরথ-কর্ত্তৃক ঋষির নিকটে
ঋষিকুমারের মৃতদেহ-স্থাপন]
বাহার--ঢিমে তেতালা
অন্ধ।
কি বলিলে, কি শুনিলাম, একি কভু হয়!
এই যে জল আনিবারে গেল সে সরযূতীরে--
কার সাধ্য বধে, সে যে ঋষির তনয়!
সুকুমার শিশু সে যে, স্নেহের বাছা রে,
আছে কি নিষ্ঠুর কেহ বধিবে যে তারে!
না না না, কোথা সে আছে-- এনে দে আমার কাছে,
সারা নিশি জেগে আছি বিলম্ব না সয়!
এখনো যে নিরুত্তর-- নাহি প্রাণে ভয়!
রে দুরাত্মা-- কী করিলি--
পুত্রব্যসনজং দুঃখং
যদেতন্মম সাংপ্রতম্।
এবং ত্বং পুত্রশোকেন
রাজন্ কালং করিষ্যসি॥
মিশ্র ভুপালি-- কাওয়ালি
দশরথ।
ক্ষমা কর মোরে তাত,
আমি যে পাতকী ঘোর,
না জেনে হয়েছি দোষী,
মার্জ্জনা নাহি কি মোর!
ও! সহে না যাতনা আর,
শান্তি পাইব কোথায়--
তুমি কৃপা না করিলে
নাহি যে কোন উপায়!
আমি দীন হীন অতি--
ক্ষম ক্ষম কাতরে,
প্রভু হে, করহ ত্রাণ
এ পাপের পাথারে।
কাফি-- আড়াঠেকা
অন্ধ।
আহা, কেমনে বধিল তোরে!
তুই যে স্নেহের পুতলি, সুকুমার শিশু ওরে!
বড় কি বেজেছে বুকে, বাছা রে,
কোলে আয়, কোলে আয় একবার--
ধূলোতে কেন লুটায়ে, রাখিব বুকে ক'রে!
[কিয়ৎক্ষণ স্তব্ধভাবে অবস্থান ও
অবশেষে উঠিয়া দাঁড়াইয়া
দশরথের প্রতি]
নটনারায়ণ
শোক তাপ গেল দূরে,
মার্জ্জনা করিনু তোরে!
[পুত্রের প্রতি]
প্রভাতী
যাও রে অনন্তধামে মোহ মায়া পাশরি
দুঃখ আঁধার যেথা কিছুই নাহি।
জরা নাহি, মরণ নাহি, শোক নাহি যে লোকে,
কেবলি আনন্দস্রোত চলিছে প্রবাহি!
যাও রে অনন্তধামে, অমৃতনিকেতনে,
অমরগণ লইবে তোমা উদারপ্রাণে!
দেব-ঋষি, রাজ-ঋষি, ব্রহ্ম-ঋষি যে লোকে
ধ্যানভরে গান করে এক তানে!
যাও রে অনন্তধামে জ্যোতিময় আলয়ে,
শুভ্র সেই চিরবিমল পুণ্য কিরণে--
যায় যেথা দানব্রত, সত্যব্রত, পুণ্যবান,
যাও বৎস, যাও সেই দেবসদনে!
[যবনিকাপতন]
[পুনরুত্থান]
[ঋষিকুমারের মৃতদেহ ঘেরিয়া বনদেবীদের গান]
ঝিঁঝিট খাম্বাজ--একতালা
সকলি ফুরাল, স্বপনপ্রায়,
কোথা সে লুকাল, কোথা সে হায়!
কুসুমকানন হয়েছে ম্লান,
পাখীরা কেন রে গাহে না গান,
ও! সব হেরি শূন্যময়,
কোথা সে হায়!
কাহার তরে আর ফুটিবে ফুল,
মাধবী মালতী কেঁদে আকুল,
সেই যে আসিত তুলিতে জল,
সেই যে আসিত পাড়িতে ফল,
ও! সে আর আসিবে না,
কোথা সে হায়!
যবনিকাপতন
সমাপ্ত