শোধবোধ (shodhbodh)
প্রথম দৃশ্য
মিস্টার লাহিড়ির ড্রয়িংরুম
তাঁর কন্যা নলিনী ও নলিনীর বন্ধু চারুবালা
চারু।
ভাই নেলি, তোর হয়েছে কী বল্ তো।
নলিনী।
মরণদশা।
চারু।
না, ঠাট্টা নয়। তোকে কেমন এক রকম দেখছি।
নলিনী।
কী রকম বল্ তো।
চারু।
তা বলতে পারব না। রাগ না অনুরাগ, না বিরাগ, তোর ভাব দেখে কিছুই বোঝবার জো নেই; কেবল এইটুকু বুঝি, তোর ঈশেন কোণে যেন মেঘ উঠেছে।
নলিনী।
শিলাবৃষ্টি না জলবৃষ্টি, না ফাঁকা ঝড়, কী আন্দাজ করছিস বল্ তো।
চারু।
তোমার আলিপুরের ওয়েদার রিপোর্ট, ভাই, আমাদের হাতে নেই। আজ পর্যন্ত তোমাকে বুঝতেই পারলুম না।
নলিনী।
তবে বুঝিয়ে দিই কেন যে মন চঞ্চল হয়েছে। ধৈর্য আর রাখতে পারছি নে। ওরে পত্তুলাল, ডেকে দে তো লালবাজার থেকে কে চিঠি নিয়ে এসেছে।
চারু।
মিস্টার নন্দীর চিঠি? কী লিখেছে।
নলিনী।।
গান
সে আমার গোপন কথা, শুনে যা ও সখী
ভেবে না পাই বলব কী।
চারু।
হাঁ ভাই, বল্ ভাই বল্, কিন্তু সাদা কথায়।
নলিনী।
অবস্থাগতিকে সাদা কথা যে রাঙা হয়ে ওঠে।
প্রাণ যে আমার বাঁশি শোনে
নীল গগনে,
গান হয়ে যায় মনে মনে যাহাই বকি।
চারু।
তুই ভাই এই-সব সখীকে-ডাক-পাড়া সেকেলে ধরনের গান কোথা থেকে জোগাড় করিস্ বল্ তো।
নলিনী।
খুব একেলে ধরনের কবির কাছ থেকেই।
চারু।
মিস্টার লাহিড়ি রাগ করেন না?
নলিনী।
বাংলা সাহিত্যে কোন্টা একেলে কোন্টা সেকেলে, সে তাঁর খেয়ালই নেই। একটি গান সব চেয়ে তাঁর পছন্দ, সেইটে তাঁকে শুনিয়ে দিলেই তিনি নিশ্চিন্ত হয়ে বোঝেন যে, ইহকাল পরকাল কোনো কালই যদি আমার না থাকে, অন্তত মডার্ন কালটা আছে --
চারু।
তোর মতো অদ্ভুত মেয়ে আমি দেখি নি -- সবই উলটো-পালটা। তুই যদি ভাটপাড়ার পণ্ডিতের ঘরে জন্মাতিস, তা হলে চটেমটে মেমসাহেব হয়ে উঠতিস। মিস্টার লাহিড়ির ঘরে জন্মেছিস বলেই বুড়ি ঠাকুরমার চাল প্র৻াকটিস চলছে। কোন্দিন এসে দেখব জ্যাকেট ছেড়ে নামাবলি ধরেছিস।
নলিনী।
তাতে আগাগোড়া ছুবিয়ে রাখব -- মিস্টার নন্দী বার-অ্যাট-ল --
চাপরাশির প্রবেশ
তোমারা সাব্কো বোলো, জবাব পিছে ভেজ দেউঙ্গী। --
[ সেলাম করিয়া চাপরাশির প্রস্থান
দেখলি, একবার চাপরাশের ঘটা দেখলি? -- গিলটি তক্মার ঝল্মলানিতে চোখ ঝলসে গেল।
চারু।
ভয় করিস্ নে নেলি। গিলটি সোনার চাপরাশ জোটে চাপরাশির ভাগ্যে, কিন্তু --
নলিনী।
হাঁ গো, আর খাঁটি সোনার চাপরাশ পরবেন মিসেস নন্দী। তাঁর কী সৌভাগ্য!
চারু।
দেখ্ নেলি, ন্যাকামি করিস্ নে। মিস্টার নন্দীর মতো পাত্র যেন অমনি --
মিসেস লাহিড়ির প্রবেশ
মিসেস লাহিড়ি।
নেলি, ছি ছি, তুই এই কাপড় প'রে মিস্টার নন্দীর বেয়ারার --
নলিনী।
কেন এ তো মন্দ কাপড় নয়।
মিসেস লাহিড়ি।
কী মনে করবে বল্ তো। ওদের বাড়িতে সব --
নলিনী।
বেহারা হয়ে জন্মেছে বলেই কি এত শাস্তি দিতে হবে। বেচারা মনিববাড়িতে চব্বিশ ঘণ্টা যা দেখে, আজ তার থেকে নতুন কিছু দেখে বেঁচে গেল। এত খুশি হল যে বকশিশ চাইতে ভুলে গেল।
মিসেস লাহিড়ি।
চিঠি দিতে এসে আবার বকশিশ চাইবে কী। তোর সব অদ্ভুত কথা।
নলিনী।
এমন আশ্চর্য চিঠি, মা, তাতে এত --
মিসেস লাহিড়ি।
এত কী।
নলিনী।
সোনালি ক্রেস্ট আঁকা। -- আর তাতে লেখা আছে তিনি স্বয়ং এখানে আসবেন -- আমাকে --
মিসেস লাহিড়ি।
কী করতে।
নলিনী।
বেশি আশা করে বোসো না, মা। প্রোপোজ করতে না, আমার জন্মদিনের জন্যে কন্গ্র৻াচুলেট করতে। সেই বা কজনের ভাগ্যে --
মিসেস লাহিড়ি।
যা, আর বকিস্ নে -- শীঘ্র যা, ড্রেস করে নে -- এখনি লোক আসতে আরম্ভ হবে। মিস্টার নন্দী তোর সেই ধূপছায়া রঙের শাড়িটা খুব অ্যাড্মায়ার করেন,সেটা --
নলিনী।
সে হবে, মা, আমি এখনি যাচ্ছি।
মিসেস লাহিড়ি।
যাই, হোটেল থেকে খানসামাগুলো এল কি না দেখিগে।
[ প্রস্থান
নলিনী।
দেখবি? এই দেখ চিঠি। সশরীরে আসবেন তার অ্যানাউন্স্মেণ্ট। সেকালে বিশু ডাকাত এইরকম খবর পাঠিয়ে ডাকাতি করত।
চারু।
ডাকাতি।
নলিনী।
নয় তো কী। একজন সরলা অবলার হৃদয়ভাণ্ডার লুঠ! তার সিঁধ-কাঠিটা দেখবি? এই দেখ্।
চারু।
ইস্। এ যে হীরে-দেওয়া ব্রেস্লেট! যা বলিস, তোর কপাল ভালো। এ বুঝি তোর জন্মদিনের --
নলিনী।
হাঁ হাঁ, জন্মদিনের উপহার -- আমার জন্ম মৃত্যু বিবাহ এই তিনকেই ঘিরে ফেলবার সুদর্শন চক্র।
চারু।
সুদর্শন চক্র বটে। যা বলিস, মিস্টার নন্দীর টেস্ট্ আছে।
নলিনী।
ব্রেসলেটও তার প্রমাণ, আর ব্রেসলেট পরাবার জন্য যে মৃণালবাহু বেছে নিয়েছেন তাতেও প্রমাণ।
চারু।
আজ যে বড়ো ঠাট্টার সুর ধরেছিস।
নলিনী।
তা হলে গম্ভীর সুর ধরি।
গান
সে যেন আসবে আমার মন বলেছে।
হাসির 'পরে তাই তো চোখের জল গলেছে।
দেখ্ লো তাই দেয় ইশারা
তারায় তারা;
চাঁদ হেসে ওই হল সারা তাহাই লখি।
শুনে যা ও সখী।
চারু।
আমি যদি পুরুষ হতুম নেলি, তা হলে তোর ঐ পায়ের কাছে প'ড়ে-
নলিনী।
জুতোর লেস লাগাতিস বুঝি? আর ব্রেসলেট পরাত কে।
মিস্টার লাহিড়ির প্রবেশ
মিস্টার লাহিড়ি।
আজ বরুণ নন্দীর আসবার কথা আছে না?
নলিনী।
হাঁ, তাঁর চিঠি পেয়েছি।
মিস্টার লাহিড়ি।
তা হলে এখনো যে ড্রেস কর নি?
নলিনী।
কী ড্রেস পরব, তাই তো এতক্ষণ চারুর সঙ্গে পরামর্শ করছিলুম।
মিস্টার লাহিড়ি।
দেখো, ভুলো না, সার হার্কোর্ট তোমাকে কী চিঠি লিখেছেন, সেইটে বরুণ নন্দী দেখতে চেয়েছিল -- সেটা --
নলিনী।
হাঁ, সেটা আমি বের করে রাখব, আর জেনেরাল্ পর্কিন্সের ভাইঝি তার অটোগ্রাফওয়ালা যে ফোটো আমাকে দিয়েছিল, সেটাও --
মিস্টার লাহিড়ি।
হাঁ হাঁ সেটা, আর সেই যে --
নলিনী।
বুঝেছি, গবর্মেণ্ট্ হাউসে নেমন্তন্নে গিয়েছিলুম, তার নাচের প্রোগ্রামটা।
মিস্টার লাহিড়ি।
আজ কোন্ গানটা গাবে বলো তো।
নলিনী।
সেই যে ঐটে --
Loves golden dream is done
Hidden in mist of pain।
মিস্টার লাহিড়ি।
হাঁ হাঁ, ফর্স্ট্ ক্লাস। ওটা তোমার গলায় খুব মানায়, আর সেইটে -- মনে আছে তো?In the gloaming, O my darling।
নলিনী।
আছে।
মিস্টার লাহিড়ি।
আর সব-শেষে গেয়োGoodbye, sweetheart।
নলিনী।
কিন্তু ওগুলো যে পুরুষের গান।
মিস্টার লাহিড়ি।
(হাসিয়া) তাতে ক্ষতি কী, নেলি -- আজকাল মেয়েরা তো --
নলিনী।
ভুলতে আরম্ভ করেছে যে তারা মেয়ে। কিন্তু মুশকিল এই যে, তাতে পুরুষদের একটুও ভুল হচ্ছে না।
মিস্টার লাহিড়ি।
Bravo, well said। যাও এবার ড্রেস করতে যাও। অমনি সেই তোমার অটোগ্রাফ বইটা, সেই যেটাতে --
নলিনী।
বুঝিছি, যেটাতে লর্ড্ বেরেস্ফোর্ডের কার্ড্ আঁটা আছে। আচ্ছা, বাবা, সে হবে এখন। তুমি তৈরি হওগে, আমি এখনি যাচ্ছি।
[ লাহিড়ির প্রস্থান
লাহিড়ি।
(ফিরিয়া আসিয়া) দেখো, একটা জিনিস নোটিস করছি নেলি, সেটা তোমাকে বলা ভালো। তুমি অনেক সময়ে বরুণের সঙ্গে এমন টোনে কথা কও যে সে মনে করে, তুমি তাকে একটুও সীরিয়াস্লি নিচ্ছ না, তাই সে ভেবে পায় না যে তুমি --
নলিনী।
বুঝেছি বাবা। সুবিধে পেলেই বুঝিয়ে দেব আমি খুব সীরিয়াস।
লাহিড়ি।
আর-একটা কথা। আমি ঠিক বুঝতে পারি নে তুমি সতীশকে কেমন যেন একটুখানি ইন্ডাল্জেন্স্ দাও।
চারু।
না মিস্টার লাহিড়ি, নেলি তো তাকে কথায় কথায় নাকের জলে চোখের জলে করে। পৃথিবীতে ওর কুকুর টম্কে ছাড়া নেলি আর যে কাউকে একটুও ইন্ডাল্জেন্স্ দেয়, এ তো আমি দেখি নি।
লাহিড়ি।
কিন্তু সে আসতেও ছাড়ে না। সেদিন চা-পার্টিতে এমন একটা জুতো পরে এসেছিল যে তার মচ্ মচ্ শব্দে দেয়ালের ইঁটগুলোকে পর্যন্ত চমকিয়ে দিয়ে গেছে। ওকে নিয়ে এক-এক সময় ভারি অক্ওঅর্ড্ হয়। তা ছাড়া ওর ট্রাউজার্গুলো -- থাক্গে, লোরেটোতে ছোটোবেলায় তোমার সঙ্গে ও একসঙ্গে পড়েছিল, ওকে আমি কিছু বলতে চাই নে, কিন্তু যেদিন বরুণরা আসবে, সেদিন বরঞ্চ ওকে --
নলিনী।
ভয় কী বাবা, সেদিন বরঞ্চ সতীশকে ট্রাউজার না পরে ধুতি পরে আসতে বলব, আর দিল্লির জুতো -- সে মচ্ মচ্ করবে না।
লাহিড়ি।
ধুতি? পার্টিতে? আবার দিল্লির নাগরা?
নলিনী।
পৃথিবীতে যে-সব বালাই অসহ্য, সেগুলো ক্রমে ক্রমে সইয়ে নেওয়া ভালো।
চারু।
ওর সঙ্গে কথায় পারবেন না। এ দিকে লোক আসবার সময় হয়ে আসছে। নেলি, তুই যা ভাই, কাপড় পরে আয়, যদি কেউ লোক আসে, আমি তাদের সামলাব।
[ নলিনীর প্রস্থান
লাহিড়ি।
এই বুঝি ওর সব জন্মদিনের প্রেজেন্ট্? বরুণের ব্রেস্লেটটা কি এমনি টেবিলের উপরেই থাকবে?
চারু।
থাক্-না, আমি ওর উপর চোখ রাখব।
লাহিড়ি।
এটা কার? একটা মক্মলের মলাটের অ্যাল্বম। এ দেখছি সতীশের! দাম লেখা আছে, মুছে ফেলতেও হুঁশ ছিল না। এক টাকা বারো আনা। ইন্সল্ভেন্সির মামলা আনতে হবে না। সেকেণ্ড্হ্যাণ্ড সেলে কেনা। এটাও কি এখানে থাকবে নাকি।
চারু।
সরাতে গেলে নেলি রক্ষা রাখবে না।
লাহিড়ি।
থাক্ তবে, তুমি এখানে একটু বোসো, আমি ড্রেস করে আসি।
[ প্রস্থান
সতীশের প্রবেশ
চারু।
এত সকাল-সকাল যে?
সতীশ।
(লজ্জিত হইয়া) দেখছি আমার ঘড়িটা ঠিক চলছিল না। যাই, বরঞ্চ আমি একটু ঘুরে আসিগে।
চারু।
না, আপনি বসুন, সময় হয়ে এসেছে। নেলির প্রেজেন্ট্গুলো দেখুন-না। এই দেখেছেন?
সতীশ।
এ যে হীরের ব্রেস্লেট! এ কে দিয়েছে।
চারু।
মিস্টার নন্দী। চমৎকার না?
সতীশ।
তাই তো। বেশ।
চারু।
এই মুক্তো-দেওয়া হেয়ার্পিনটা আমার ভাই অমূল্যর দেওয়া। আর এই রুপোর দোয়াতদান -- ও কী সতীশবাবু, যাচ্ছেন নাকি?
সতীশ।
ভাবছি এইবেলা আমার কাজ সেরে আসি।
চারু।
আপনার অ্যাল্বমটি নেলির কাজে লাগবে। এই দেখুন-না মিস্টার নন্দী ওকে তাঁর সই-করা ফোটো পাঠিয়ে দিয়েছেন।
সতীশ।
হাঁ, তাই তো দেখছি। আমার কিন্তু বিশেষ কাজ আছে, আমি যাই।
আর দেখুন, এখনকার মতো এই অ্যাল্বমটা আমি নিয়ে যাচ্ছি -- তার পরে --
চারু।
কী করবেন।
সতীশ।
না, ওটা -- একবার -- একটুখানি ঐ -- আপনি দয়া করে নেলিকে বলবেন যে, বিশেষ একটু কারণে এখনকার মতো -- তার পরে আবার -- এখন যাই -- কাজ আছে।
[ প্রস্থান
চারু।
যাক, বিদায় করে দেওয়া গেল। মা গো, কী টাই পরেই এসেছে। অ্যাল্বমটাও গেল। এই-যে মিস্টার লাহিড়ি, শুনে যান, সুখবর আছে, বকশিশ চাই।
নেপথ্যে।
একটু পরেই যাচ্ছি, আমার বাট্ন্হুক্টা খুঁজে পাচ্ছি নে।
সতীশকে লইয়া নলিনীর প্রবেশ
চারু।
ও কী, নেলি, তোর ভালো করে তো সাজা হল না।
নলিনী।
হঠাৎ কোতোয়ালি করতে হল। ড্রেসিংরুমের জানলা দিয়ে দেখি, চোর পালাচ্ছে একটা মাল বগলে নিয়ে, তখনই নেমে গিয়ে বমালসুদ্ধ গ্রেফতার করে নিয়ে এসেছি।
চারু।
বাস্ রে, কী কড়া পাহারা। মালটা কি খুবই দামি, আর চোরটাও কি খুবই দাগি।
নলিনী।
(সতীশকে) তুমি এসেই তখনই পালাচ্ছিলে যে -- আর আমার একখানা অ্যাল্বম নিয়ে?
[ সতীশ নিরুত্তর
চারু।
ওঃ বুঝেছি, প্রাইভেট কামরায় বিচার হবে। নেলি, আমি তা হলে তৈরি হয়ে আসিগে। তোর নাবার ঘরে টয়লেট ভিনিগার আছে তো?
নলিনী।
আছে। --
[ চারুর প্রস্থান
তোমার এ কী রকম দুর্বুদ্ধি। আমার অ্যাল্বম নিয়ে --
সতীশ।
লক্ষ্মীছাড়ার দান লক্ষ্মীকে পৌঁছয় না। যেটা যার যোগ্য নয়, সে জিনিসটা তার নয়, আমি এই বুঝি।
নলিনী।
আর বগলে করে যে নিয়ে যায় সেটা যে তারই, এই-বা কোন্ শাস্ত্রে লেখে?
সতীশ।
তবে সত্যি কথাটা বলি। আমি যে ভীরু, বেশ জোরের সঙ্গে কিছুই দিতে পারি নে। সেইজন্যে দিয়ে লজ্জা পাই।
নলিনী।
তোমার এই অ্যাল্বমের মধ্যে কম জোরের লক্ষণটা কী দেখলে। এ তো টক্টকে লাল।
সতীশ।
লজ্জায় লাল। কতবার মনে হয়েছিল, এই অ্যাল্বমের মধ্যে নিজের একখানা ছবি পুরে দিই, "আমাকে মনে রেখো ' এই করুণ দাবিটুকু বোঝাবার জন্যে। কিন্তু ভয় হল তুমি মনে করবে ওটা আমার স্পর্ধা; খালি রেখে দিলুম, তুমি নিজে ইচ্ছে করে যার ছবি রাখবে ওর মধ্যে তারই স্থান থাক।
নলিনী।
খুব ভালো বলছ, সতীশ, ইচ্ছে করছে বইয়ে লিখে রাখি।
সতীশ।
ঠাট্টা কোরো না।
নলিনী।
আমার আর-একজনের কথা মনে পড়ছে। সে দিয়েছিল একখানা খাতা -- তোমার অ্যাল্বমের মধ্যে যে-কথাটা না-লেখা অক্ষরে আছে, সেইটে সে গানে লিখে দিয়েছিল -- শুধু তাই নয়, পাছে চোখে না পড়ে, তাই নিজে এসে গেয়ে শুনিয়েছিল --
পাতাখানি শূন্য রাখিলাম,
নিজের হাতে লিখে রেখো শুধু আমার নাম।
সতীশ।
কে লোকটা কে।
নলিনী।
তার সঙ্গে ডুয়েল লড়তে যাবে নাকি। আমাদের কবি গো -- কিন্তু কবিত্বে তুমি তাকেও ছাড়িয়ে গেছ -- তোমার এ যে আন্হার্ড মেলডি। আমি শুনতে পাচ্ছি --
এই অ্যাল্বম শূন্য রইল সবি,
নিজের হাতে ভরে রেখো শুধু আমার ছবি। --
কিন্তু তোমার সব কথা বলা হয় নি।
সতীশ।
না, হয় নি। বলি তা হলে। এসে দেখলুম -- সবাই আমার মতো ভীরু নয়। যার জোর আছে, সে নিজের ছবিতে নিজের নাম লিখে পাঠাতে সংকোচ করে না। মনে বুঝলুম, আমি দিয়েছি শূন্য পাতা, আর তারাই দিলে পূর্ণ করবার জিনিস।
নলিনী।
তোমাকে এখনই বুঝিয়ে দিচ্ছি ভুল করেছে সে। ছবি দিতে সবাই পারে, ছবি রাখবার জায়গা দিতে কজন পারে। ভীরু, তোমার অদৃশ্য ছবিরই জিত থাক। (নন্দীর ছবি ছিঁড়িয়া ফেলিল) ও কী, অমন করে লাফিয়ে উঠলে কেন। মৃগীরোগে ধরল নাকি।
সতীশ।
কোন্ রোগে ধরেছে তা অন্তর্যামী জানেন। নেলি, একবার তুমি আমাকে স্পষ্ট করে --
নলিনী।
এই বুঝি নাটক শুরু হল? চোখের সামনে দেখলে তো যে-ছবি চেঁচিয়ে কথা কয়, তার কী দশা। যে মানুষ চুপ করে থাকতে জানে না, তারও --
সতীশ।
আর কাজ নেই, নেলি, থাক্। তোমাকে কত ভয় করি, তুমি জানো না।
নলিনী।
ভয় যদি কর তা হলে অ্যাল্বম চুরি কোরো না। আমি কাপড় ছেড়ে আসিগে।
সতীশ।
একটি অনুরোধ। আন্হার্ড মেলডি আমার মুখে খুবই মিষ্টি, কিন্তু তোমার মুখে নয়। তোমার জন্মদিনে তোমার মুখে একটি গান শুনে যাব।
নলিনী।
আচ্ছা।
গান
বেদনায় ভরে গিয়েছে পেয়ালা,
নিয়ো হে নিয়ো।
হৃদয় বিদারি হয়ে গেল ঢালা,
পিয়ো হে পিয়ো।
ভরা সে পাত্র, তারে বুকে ক'রে
বেড়ানু বহিয়া সারা রাতি ধরে--
লও তুলে লও আজি নিশিভোরে, প্রিয় হে প্রিয়।
বাসনার রঙে লহরে লহরে
রঙিন হল।
করুণ তোমার অরুণ অধরে
তোলো হে তোলো।
এ রসে মিশাক তব নিশ্বাস,
নবীন উষার পুষ্পসুবাস--
এরই 'পরে তব আঁখির আভাস
দিয়ো হে দিয়ো।
চারুর প্রবেশ
চারু।
এ কী করেছিস, নেলি। মিস্টার নন্দীর ফোটো --
নলিনী।
যে-মাটির গর্ভে হীরে থাকে, যে-মাটির বুকে ভুঁইচাঁপা ফুল ফোটে, সেই মাটির হাতে ওকে সমর্পণ করে দিয়েছি। এর চেয়ে আর কত সম্মান হবে?
চারু।
ছি ছি, নেলি, মিস্টার নন্দী জানতে পারলে কী মনে করবেন। এ যে একেবারে ছিঁড়ে ফেলেছিস।
নলিনী।
ইচ্ছে করিস তো তোর ঘরের আটা দিয়ে তুই জোড়া দিয়ে নিতে পারিস।
দ্বিতীয় দৃশ্য
বিধুমুখী ও সতীশ
সতীশ।
মা, কোনোমতে টাকাটা পেয়েছি, নেক্লেসও নেলির ওখানে পাঠিয়ে দিয়েছি। কিন্তু বাবার সেকালের আমলের সোনার গুড়গুড়িটা সিদুঁরেপটির মতি পালদের ওখানে যে বাঁধা রেখে এলুম, নিশ্চিন্তি হতে পারছি নে।
বিধুমুখী।
তোর কোনো ভয় নেই, সতীশ। তিনি এ-সব জিনিসের পরে কোনো মমতাই রাখেন না। কেবল ওঁর ঠাকুরদাদার জিনিস বলেই আজ পর্যন্ত লোহার সিন্দুকে ছিল। একদিনের জন্যে খবরও রাখেন নি। সেটা আছে কি গেছে, সে তাঁর মনেও নেই।
সতীশ।
সে আমি জানি। কিন্তু ভারি ভয় হচ্ছে, যারা বন্ধক রেখেছে তারা হয়তো বাবাকে চিঠি লিখে খোঁজ করবে। তুমি কোনোমতে তোমার গহনাপত্র দিয়ে সেটা খালাস করে দাও।
বিধুমুখী।
হায় রে কপাল, গহনাপত্র কিছু কি বাকি আছে। সে কথা আর জিজ্ঞাসা করিস নে। যাই হোক, আমি ভয় করি নে -- প্রজাপতির আশীর্বাদে নলিনীর সঙ্গে আগে তোর কোনোমতে বিয়ে হয়ে যাক, তার পরে তোর বাবা যা বলেন, যা করেন, সব সহ্য হবে। কথাবার্তা কিছু এগিয়েছে?
সতীশ।
সর্বদা যে-রকম লোক ঘিরে থাকে, কথা কব কখন্। জান তো সেই নন্দী -- সে যেন বিলিতি কাঁটাগাছের বেড়া। তার বুলিগুলো সর্বাঙ্গে বিঁধতে থাকে। সেই দৈত্যটার হাত থেকে রাজকন্যার উদ্ধার করি কী উপায়ে।
বিধুমুখী।
আমি মেয়েমানুষ, মেয়ের মন বুঝতে পারি -- মনে মনে সে তোকে ভালোবাসে।
সতীশ।
সে আমি জানি নে। কিন্তু বরুণ নন্দীর সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে প্রাণ বেরিয়ে গেল। বাবা একটু দয়া করলেই কোনো ভাবনা ছিল না। কিন্তু --
বিধুমুখী।
তোর কী চাই বল্-না।
সতীশ।
ভালো বিলিতি সুট। চাঁদনির কাপড় পরলেই ভরসা কমে যায়; নন্দীর মতো করে সজোরে নলিনীর সঙ্গে কথাই কইতে পারি নে। বাড়িসুদ্ধ সব্বাই আমার দিকে এমন করে তাকায় যেন আমার গায়ে কাপড়ই নেই, আছে নর্দমার পাঁক।
বিধুমুখী।
আমি তোর কাপড়ের দুর্দশা তোর মাসিকে আভাসে জানিয়ে রেখেছি। আজ এখনই তাঁর আসবার কথা। আজই হয়তো একটা কিনারা হয়ে যাবে।
সতীশ।
ঐ যে মেসোমশায়কে নিয়েই তিনি আসছেন মা, যেমন করে পার আজই যেন -- কিন্তু মা, সেই গুড়গুড়ি -- বাবা যদি জানতে পারেন, মেরে ফেলবেন।
বিধুমুখী।
আমি বলি কী -- কোনো ছুতোয় সেই নেক্লেসটা যদি নলিনীর কাছ থেকে --
সতীশ।
সে কথাও ভেবেছি। তা হলেই আমার লজ্জা পুরো হয়। এক-একবার মনে করি, সংসারে যত মুশকিল সব আমারই? বরুণ নন্দীর বাপ কি কোনোকালে ছিল না। যে-রকম দেখছি, একটা কোনো গল্প বলে নেক্লেসটা ফিরিয়ে আনতে হবে, তার পরে আমার নিজের গলায় পরবার জন্যে গয়না মিলবে।
বিধুমুখী।
সে আবার কী।
সতীশ।
একগাছা দড়ি।
বিধুমুখী।
দেখ্, আমাকে আর রোজ রোজ কাঁদাস্ নে। আমার রক্ত শুকিয়ে গেল, চোখের জলও বাকি নেই। এক দিকে তোর বাবা, আর-এক দিকে তুই -- উপরে সরার চাপ আর নীচে আগুন, আমি যে গুমে গুমে--
সতীশের মাসি সুকুমারী ও মেসোমশায় শশধরবাবুর প্রবেশ
এসো দিদি, বোসো। আজ কোন্ পুণ্যে রায়মশায়ের দেখা পাওয়া গেল। দিদি না আসলে তোমার আর দেখা পাবার জো নেই।
শশধর।
এতেই বুঝবে তোমার দিদির শাসন কী কড়া। দিনরাত্রি চোখে চোখে রাখেন।
সুকুমারী।
তাই বটে, এমন রত্ন ঘরে রেখেও নিশ্চিন্ত মনে ঘুমনো যায় না।
বিধুমুখী।
নাক ডাকার শব্দে!
সুকুমারী।
সতীশ, ছি ছি, তুই এ কী কাপড় পরেছিস। তুই কি এইরকম ধুতি পরে কলেজে যাস নাকি। বিধু, ওকে যে লাউঞ্জ সুটটা কিনে দিয়েছিলেম, সে কী হল।
বিধুমুখী।
সে ও কোন্কালে ছিঁড়ে ফেলেছে।
সুকুমারী।
তা তো ছিঁড়বেই। ছেলেমানুষের গায়ে এক কাপড় কতদিন টেকে। তা, তাই বলে কি আর নূতন সুট তৈরি করাতে নেই। তোদের ঘরে সকলই অনাসৃষ্টি।
বিধুমুখী।
জানই তো দিদি, তিনি ছেলের গায়ে সভ্য কাপড় দেখলেই আগুন হয়ে ওঠেন। আমি যদি না থাকতেম তো তিনি বোধ হয় ছেলেকে দোলাই গায়ে দিয়ে কোমরে ঘুনসি পরিয়ে ইস্কুলে পাঠাতেন -- মা গো, এমন সৃষ্টিছাড়া পছন্দও কারো দেখি নি।
সুকুমারী।
মিছে না। এক বৈ ছেলে নয়, একটু সাজাতে-গোজাতেও ইচ্ছা করে না? এমন বাপও তো দেখি নি। সতীশ, আমি তোর জন্য একসুট কাপড় র৻াম্জের ওখানে অর্ডার দিয়ে রেখেছি। আহা, ছেলেমানুষের কি শখ হয় না।
সতীশ।
এক সুটে আমার কি হবে, মাসিমা। লাহিড়ি সাহেবের ছেলে আমার সঙ্গে একসঙ্গে পড়ে -- সে আমাকে তাদের বাড়িতে টেনিস খেলায় নিমন্ত্রণ করেছে, আমি নানা ছুতো করে কাটিয়ে দিই। আমার তো কাপড় নেই।
শশধর।
তেমন জায়গায় নিমন্ত্রণে না যাওয়াই ভালো, সতীশ।
সুকুমারী।
আচ্ছা আচ্ছা, তোমার আর বক্তৃতা দিতে হবে না। ওর যখন তোমার মতন বয়স হবে, তখন --
শশধর।
তখন ওকে বক্তৃতা দেবার অন্য লোক হবে, বৃদ্ধ মেসোর পরামর্শ শোনবার অবসর হবে না।
সুকুমারী।
আচ্ছা মশায়, বক্তৃতা করবার অন্য লোক যদি তোমাদের ভাগ্যে না জুটত, তবে তোমাদের কী দশা হত বলো দেখি।
শশধর।
সে কথা বলে লাভ কী। সে অবস্থা চোখ বুজে কল্পনা করাই ভালো।
ভৃত্যের প্রবেশ
ভৃত্য।
কর্তাবাবু লোহার সিন্দুকের চাবি চেয়েছেন।
সতীশ।
(কানে কানে) সর্বনাশ মা, সর্বনাশ। নিশ্চয় গুড়গুড়ির খোঁজ পড়েছে।
বিধুমুখী।
একটু চুপ কর্ তুই। কেন রে, চাবি কেন।
ভৃত্য।
কাল কোথায় যাবেন, চেক-বইটা চান।
বিধুমুখী।
আচ্ছা, একটু সবুর করতে বল্, চাবি নিয়ে এখনই যাচ্ছি।
[ ভৃত্যের প্রস্থান
সতীশ।
মা, লোহার সিন্দুক খুললেই তো --
বিধুমুখী।
একটু থাম্। আমাকে একটু ভাবতে দে।
সতীশ।
(নেপথ্যের দিকে চাহিয়া) না, না, এখানে আনতে হবে না, আমি যাচ্ছি।
[ প্রস্থান
সুকুমারী।
সতীশ ব্যস্ত হয়ে পালালো কেন, বিধু।
বিধুমুখী।
থালায় করে তার জলখাবার আনছিল কিনা, ছেলের তাই তোমাদের সামনে লজ্জা।
সুকুমারী।
আহা, বেচারার লজ্জা হতে পারে। ও সতীশ, শোন্ শোন্।
সতীশের প্রবেশ
-- তোর মেসোমশায় তোকে পেলেটির বাড়ি থেকে আইস্ক্রিম খাইয়ে আনবেন, তুই ওঁর সঙ্গে যা। ওগো যাও-না -- ছেলেমানুষকে একটু --
সতীশ।
মাসিমা, সেখানে কী কাপড় পরে যাব।
বিধুমুখী।
কেন,তোর তো চাপকান আছে।
সতীশ।
চাপকান তো পেলেটির খানসামাদেরও আছে। বেমালুম দলে মিশে যাব।
সুকুমারী।
আর যাই হোক বিধু, তোর ছেলে ভাগ্যে পৈতৃক পছন্দটা পায় নি, তাই রক্ষা। বাস্তবিক, চাপকান দেখলেই খানসামা কিম্বা যাত্রার দলের ছেলে মনে পড়ে। এমন অসভ্য কাপড় আর নেই।
শশধর।
এ কথাগুলো --
সুকুমারী।
চুপি চুপি বলতে হবে? কেন, ভয় করতে হবে কাকে। মন্মথ নিজের পছন্দমতো ছেলেকে সাজ করাবেন আর আমরা কথা কইতেও পাব না?
শশধর।
সর্বনাশ! কথা বন্ধ করতে আমি বলি নে। কিন্তু সতীশের সামনে এ-সমস্ত আলোচনা --
সুকুমারী।
আচ্ছা আচ্ছা, বেশ। তুমি ওকে পেলেটির ওখানে নিয়ে যাও।
সতীশ।
(জনান্তিকে) মা, লোহার সিন্দুকের চাবি বাবাকে কিছুতেই দিয়ো না -- বরঞ্চ আমার সেই ঘড়ির কথাটা তুলে ওঁর সঙ্গে ঝগড়া বাধিয়ে ভুলিয়ে রেখো।
সুকুমারী।
এই-যে মন্মথ আসছেন। এখনই সতীশকে নিয়ে বকাবকি করে অস্থির করে তুলবেন। আয় সতীশ, তুই আমার সঙ্গে আয় -- আমরা পালাই।
[ প্রস্থান
মন্মথের প্রবেশ
বিধুমুখী।
সতীশ ঘড়ি ঘড়ি করে কদিন আমাকে অস্থির করে তুলেছিল। দিদি তাকে একটা রুপোর ঘড়ি দিয়েছেন। আগে থাকতে বলে রাখলেম, তুমি আবার শুনলে রাগ করবে।
মন্মথ।
আগে থাকতে বলে রাখলেও রাগ করব। -- শোনো, লোহার সিন্দুকের চাবিটা --
বিধুমুখী।
তুমি একলা বসে বসে রাগ করো। আমি চললুম, আমি আর সইতে পারছি নে।
[ প্রস্থান
মন্মথ।
শশধর, সে-ঘড়িটা তোমায় ফিরে নিয়ে যেতে হবে।
শশধর।
তুমি যে লোহার সিন্দুক খুলতে যাচ্ছিলে, যাও-না।
মন্মথ।
সে পরে হবে, কিন্তু ঘড়িটা এখনই তুমি নিয়ে যাও।
শশধর।
তুমি তো আচ্ছা লোক। ঘড়ি তো নিয়ে গেলুম; তার পর থেকে আমার সময়টা কাটবে কী রকম? ঘরের লোকের কাছে জবাবদিহি করতে গিয়ে আমাকে যে ঘরছাড়া হতে হবে।
মন্মথ।
না শশধর, ঠাট্টা নয়, আমি এ-সব ভালোবাসি নে।
শশধর।
ভালোবাস না, কিন্তু সহ্যও করতে হয়। সংসারের এই নিয়ম।
মন্মথ।
নিজের সম্বন্ধে হলে নিঃশব্দে সহ্য করতেম। ছেলেকে মাটি করতে পারি না।
শশধর।
সে তো ভালো কথা। কিন্তু স্ত্রীলোকের ইচ্ছার একেবারে খাড়া উলটোমুখে চলতে গেলে বিপদে পড়বে। তার চেয়ে পাশ কাটিয়ে ঘুরে গেলে ফল পাওয়া যায়। বাতাস যখন উলটো বয়, জাহাজের পাল তখন আড় করে রাখতে হয়, নইলে চলা অসম্ভব।
মন্মথ।
তাই বুঝি তুমি গৃহিণীর সকল কথাতেই সায় দিয়ে যাও। ভীরু!
শশধর।
তোমার মতো অসমসাহস আমার নেই। যার ঘরকন্নার অধীনে চব্বিশ ঘণ্টা বাস করতে হয়, তাঁকে ভয় না করব তো কাকে করব। নিজের স্ত্রীর সঙ্গে বীরত্ব করে লাভ কী। আঘাত করলেও কষ্ট, আঘাত পেলেও কষ্ট। তার চেয়ে তর্কের বেলায় গৃহিণীর যুক্তিকে অকাট্য বলে কাজের বেলায় নিজের যুক্তিতে চলাই সৎপরামর্শ -- গোঁয়ার্তমি করতে গেলেই মুশকিল বাধে। আমি চললেম, যা ভালো বোঝ করো।
[ শশধরের প্রস্থান
বিধুমুখীর প্রবেশ
মন্মথ।
তোমার ছেলেটিকে যে বিলাতি পোশাক পরাতে আরম্ভ করেছ, সে আমার পছন্দ নয়।
বিধুমুখী।
পছন্দ বুঝি একা তোমারই আছে। আজকাল তো সকলেই ছেলেদের ইংরেজি কাপড় ধরিয়েছে।
মন্মথ।
(হাসিয়া) সকলের মতেই যদি চলবে, তবে সকলকে ছেড়ে একটিমাত্র আমাকেই বিয়ে করলে কেন।
বিধুমুখী।
তুমি যদি একমাত্র নিজের মতেই চলবে, তবে একা না থেকে আমাকেই বা তোমার বিয়ে করবার কী দরকার ছিল।
মন্মথ।
নিজের মত চালাবার জন্যও যে অন্য লোকের দরকার হয়।
বিধুমুখী।
নিজের বোঝা বহাবার জন্য ধোবার দরকার হয় গাধাকে -- কিন্তু আমি তো আর --
মন্মথ।
(জিব কাটিয়া) আরে রাম রাম, তুমি আবার সংসারমরুভূমির আরব ঘোড়া। কিন্তু সে প্রাণিবৃত্তান্তের তর্ক এখন থাক্। তোমার ছেলেটিকে সাহেব করে তুলো না।
বিধুমুখী।
কেন করব না। তাকে কি চাষা করব।
মন্মথ।
লোহার সিন্দুকের চাবিটা --
বিধবা জায়ের প্রবেশ
জা।
ভাই, তোমরা এখানে ভালো হয়ে বসেই কথা কও-না। দাঁড়িয়ে কেন। আমি পাশের ঘরে আছি বলে বুঝি আলাপ জমছে না? ভয় নেই ভাই, আমি নীচের ঘরে যাচ্ছি।
[ প্রস্থান
সতীশের প্রবেশ ও বাপকে দেখিয়াই পলায়ন
মন্মথ।
ও কী ও, তোমার ছেলেটিকে কী মাখিয়েছ।
বিধুমুখী।
মূর্ছা যেয়ো না, ভয়ানক কিছু নয়, একটুখানি এসেন্স্ মাত্র। তাও বিলাতি নয় -- তোমাদের সাধের দিশি।
মন্মথ।
আমি তোমাকে বারবার বলেছি, ছেলেদের তুমি এ-সমস্ত শৌখিন জিনিস অভ্যাস করাতে পারবে না।
বিধুমুখী।
আচ্ছা, যদি তোমার আরাম বোধ হয় তো কাল থেকে মাথায় কেরোসিন মাখাব, আর গায়ে কাস্টর-অয়েল।
মন্মথ।
সেও বাজে খরচ হবে। কেরোসিন কাস্টর-অয়েল গায়-মাথায় মাখা আমার মতো অনাবশ্যক।
বিধুমুখী।
তোমার মতে আবশ্যক জিনিস কটা আছে তা তো জানি না, গোড়াতেই আমাকে বোধ হয় বাদ দিয়ে বসতে হয়।
মন্মথ।
তোমাকে বাদ দিলে যে বাদপ্রতিবাদ একেবারেই বন্ধ হবে। এতকালের দৈনিক অভ্যাস হঠাৎ ছাড়লে এ-বয়সে হয়তো সহ্য হবে না। যাই হোক, এ কথা আমি তোমাকে আগে থাকতে বলে রাখছি, ছেলেটিকে তুমি সাহেব কর বা নবাব কর, তার খরচ আমি জোগাব না। আমার মৃত্যুর পরে সে যা পাবে, তাতে তার শখের খরচ চলবে না।
বিধুমুখী।
সে আমি জানি। তোমার টাকার উপরে ভরসা রাখলে ছেলেকে কপনি পরানো অভ্যাস করাতেম।
মন্মথ।
আমিও তা জানি। তোমার ভগিনীপতি শশধরের পরেই তোমার ভরসা। তার সন্তান নেই বলে ঠিক করে বসে আছ, তোমার ছেলেকেই সে উইলে সমস্ত লিখে-পড়ে দিয়ে যাবে। সেইজন্যই যখন-তখন ছেলেটাকে ফিরিঙ্গি সাজিয়ে এক-গা গন্ধ মাখিয়ে তার মেসোর আদর কাড়বার জন্য পাঠিয়ে দাও! আমি দারিদ্র৻ের লজ্জা অনায়াসেই সহ্য করতে পারি; কিন্তু ধনী কুটুম্বের সোহোগ-যাচনার লজ্জা আমার সহ্য হয় না।
বিধুমুখী।
ছেলেকে মাসির কাছে পাঠালেও গায়ে সয় না, এতবড়ো মানী লোকের ঘরে আছি, সে তো পূর্বে বুঝতে পারি নি।
বিধবা জায়ের প্রবেশ
জা।
ভাবলুম এতক্ষণে কথা ফুরিয়ে গেছে, এইবার ঘরে এসে পানগুলো সেজে রাখি। কিন্তু এখনো ফুরোল না। মেজোবউ, তোদের ধন্য। আজ সে তোর ন-বছর বয়স থেকে শুরু হয়েছে, তবু তোদের কথা যে আর ফুরোল না! রাত্রে কুলোয় না, শেষকালে দিনেও দুই জনে মিলে ফিস্ ফিস্। তোদের জিবের আগায় বিধাতা এত মধু দিনরাত্রি জোগান কোথা থেকে, আমি তাই ভাবি। রাগ কোরো না ঠাকুরপো, তোমাদের মধুরালাপে ব্যাঘাত করব না।
বিধুমুখী।
না দিদি, আমাদের মধুরালাপ লোকালয় থেকে অনেক দূরে গিয়েই করতে হবে, নইলে সবাই দৃষ্টি দেবে। ওগো, এসো -- ছাতে এসো, গোটাকতক কথা বলে রাখি। তুমি আবার নাকি হঠাৎ কাল লঙ্কাদ্বীপে যাচ্ছ -- এখানকার হাওয়া তোমার সহ্য হচ্ছে না?
[ উভয়ের প্রস্থান
সতীশের প্রবেশ
সতীশ।
জেঠাইমা!
জেঠাইমা।
কী বাপ!
সতীশ।
বাবা কাল ভোরে জাহাজে করে কলম্বো যাবেন, তাই কালই লাহিড়ি-সাহেবের ছেলেকে মা চা খাওয়াতে ডেকেছেন, তুমি যেন সেখানে হঠাৎ গিয়ে পোড়ো না।
জেঠাইমা।
আমার যাবার দরকার কী, সতীশ।
সতীশ।
যদি যাও তো তোমার এ-কাপড়ে চলবে না, তোমাকে--
জেঠাইমা।
সতীশ, তোর কোনো ভয় নেই, আমি এই ঘরেই থাকব, যতক্ষণ তোর বন্ধুর চা খাওয়া না হয় আমি বার হব না।
সতীশ।
জেঠাইমা, আমি মনে করছি, তোমার ঐ সামনের ঘরটাতেই তাকে চা খাওয়াবার বন্দোবস্ত করব। এ-বাড়িতে আমাদের যে ঠাসাঠাসি লোক -- চা খাবার ডিনার খাবার মতো ঘর একটাও খালি পাবার জো নেই। মার শোবার ঘরে সিন্দুক-ফিন্দুক কত কী রয়েছে, সেখানে কাকেও নিয়ে যেতে লজ্জা করে।
জেঠাইমা।
আমার ও-ঘরেও তো জিনিসপত্র --
সতীশ।
ওগুলো বার করে দিতে হবে। বিশেষত তোমার ঐ বঁটি-চুপড়ি-বারকোশগুলো কোথাও না লুকিয়ে রাখলে চলবে না।
জেঠাইমা।
কেন বাবা, ওগুলোতে এত লজ্জা কিসের। তাদের বাড়িতে কি কুটনো কুটবার নিয়ম নেই।
সতীশ।
তা জানি নে জেঠাইমা, কিন্তু চা খাবার ঘরে ওগুলো রাখা দস্তুর নয়। এ দেখলে নরেন লাহিড়ি নিশ্চয় হাসবে, বাড়ি গিয়ে তার বোনদের কাছে গল্প করবে।
জেঠাইমা।
শোনো একবার, ছেলের কথা শোনো। বঁটি-চুপড়ি তো চিরকাল ঘরেই থাকে। তা নিয়ে ভাইবোনে মিলে গল্প করতে তো শুনি নি।
সতীশ।
তোমাকে আর-এক কাজ করতে হবে, জেঠাইমা -- আমাদের নন্দকে তুমি যেমন করে পার এখানো ঠেকিয়ে রেখো। সে আমার কথা শুনবে না, খালি-গায়ে ফস্ করে সেখানে গিয়ে উপস্থিত হবে।
জেঠাইমা।
তাকে যেন ঠেকালেম, কিন্তু তোমার বাবা যখন খালি-গায়ে --
সতীশ।
তিনি তো কাল কলম্বোয় যাবেন।
জেঠাইমা।
বাবা সতীশ, যা মন হয় করিস, কিন্তু আমার ঘরটাতে তোদের ঐ খানাটানাগুলো --
সতীশ।
সে ভালো করে সাফ করিয়ে দেব এখন।
[ জেঠাইমার প্রস্থান
বিধুমুখীর প্রবেশ
বিধুমুখী।
পারলুম না। -- জানো তো সতীশ, তিনি যা ধরেন তা কিছুতেই ছাড়েন না। কত টাকা হলে তোমার মনের মতো পোশাক হয় শুনি।
সতীশ।
একটা মর্নিং সুট তো মাসি অর্ডার দিয়েছেন, আর একটা লাউঞ্জ সুটে একশো টাকার কাছাকাছি লাগবে। একটা চলনসই ইভনিং ড্রেস দেড়শো টাকার কমে কিছুতেই হবে না।
বিধুমুখী।
বলো কী, সতীশ। এ তো আড়াইশো টাকার ধাক্কা, এত টাকা--
সতীশ।
মা, ঐ তোমাদের দোষ। এক ফকিরি করতে চাও সে ভালো, আর যদি ভদ্রসমাজে মিশতে হয় তো খরচ করতে হবে। সুন্দরবনে পাঠিয়ে দাও-না কেন, সেখানে বনের বাঁদররা ড্রেস কোট পরে না। -- কিন্তু মা, সেই গুড়গুড়ি! একটা প্ল্যান ভেবেছি, তুমি বাবাকে বলো যে কাল রাত্রে তোমার লোহার সিন্দুকের চাবি চুরি গেছে।
বিধুমুখী।
দেখ্ সতীশ, এদিকে তোর বাবার বিষয়বুদ্ধি একটুও নেই -- কিন্তু ওঁকে ফাঁকি দেওয়া শক্ত। ধরা পড়ে যাবি।
সতীশ।
ধরা তো এক সময়ে পড়বই। আপাতত কোনোরকম ক'রে -- তা ছাড়া কাল তো উনি কলম্বোয় যাচ্ছেন, ইতিমধ্যে যা হয় একটা উপায় করা যাবে। যথেষ্ট সময় পেলে নেক্লেসটা চাই কি ফিরিয়েও নিতে পারি। অনেক ভেবে দেখলুম শেষকালে -- ঐ যে বাবা আসছেন। মা, এখনই, আর দেরি কোরো না।
[সতীশের প্রস্থান
শশধর ও মন্মথের প্রবেশ
বিধুমুখী।
ওগো শুনছ, সর্বনাশ হয়েছে। কাল রাত্রে লোহার সিন্দুকের চাবি চুরি গেছে।
শশধর।
সে কী কথা, বউ। কোথায় চাবি রেখেছিলে, কে করলে এমন কাজ।
বিধুমুখী।
তাই তো ভাবছি, হয়তো নতুন বেহারাটা-
শশধর।
মন্মথ, তুমি যে একেবারে অবিচলিত? একবার খোঁজ করে দেখো।
মন্মথ।
কোনো লাভ নেই।
শশধর।
কী গেল না-গেল, সেটা তো একবার দেখাও চাই।
মন্মথ।
কিছু নিশ্চয় গেছে, শুধু চাবি নিয়ে ঝম্ঝমিয়ে বেড়াবে, চোরের এমন শখ প্রায় থাকে না।
শশধর।
কিন্তু কে চোর, সেটাও তো বের করা চাই।
মন্মথ।
সাধুর চেয়ে যার দরকার অনেক বেশি, সেই হয় চোর।
শশধর।
আমি কি তোমার কাছে চোরের ডেফিনিশন চাচ্ছি। বলছি -- সন্ধান করা চাই তো?
মন্মথ।
(উত্তেজনার সহিত) না, চাই নে, চাই নে। ভিতরে যে আছে তাকে বাইরে সন্ধান করতে যাওয়া বিড়ম্বনা।
শশধর।
কী বলছ, মন্মথ। চলো-না একবার দেখেই আসা যাক।
মন্মথ।
নিষ্ফল, নিষ্ফল, আমার দেখাশোনা হয়ে গেছে।
শশধর।
অন্তত কালকে কলম্বো যাওয়াটা স্থগিত রাখো, একটা পুলিস-তদন্ত করাও।
মন্মথ।
কলম্বোর চেয়ে আরো অনেক দূরে যাওয়া দরকার -- সাউথ পোলে যেখানে থাকে পেঙ্গুয়িন পাখি, যেখানে থাকে সিন্ধুঘোটক -- সেখানে চাবিও চুরি যায় না আর পুলিস-তদন্তর ঠাট বসাতে হয় না।
শশধর।
বউ, তুমি যে একেবারে চুপ, মুখ হয়ে গেছে সাদা। চলো বরঞ্চ তোমাতে আমাতে একবার --
ভৃত্যের প্রবেশ
ভৃত্য।
সাহেববাড়ি থেকে এই কাপড় এসেছে।
মন্মথ।
নিয়ে যা কাপড় নিয়ে যা, এখনই নিয়ে যা।
[ ভৃত্যের প্রস্থান
শশধর।
আহা, আহা, করছ কী মন্মথ। কাপড় ফিরিয়ে দিয়ে তুমি আমাকেই --
মন্মথ।
ঐ কাপড়গুলোতেই আছে চাবি-চুরির ব্যাকটিরিয়া -- টাকা-চুরির বীজ -- এই আমি তোমাকে বলে গেলুম।
[ মন্মথের প্রস্থান। বিধুমুখীর মেজের উপর উপুড় হইয়া কান্না
শশধর।
বউ, ছি ছি, এমন করে কাঁদতে নেই। ওঠো ওঠো।
বিধুমুখী।
রায়মশায়, আমার বেঁচে সুখ নেই।
শশধর।
কিছুই বুঝতে পারছি নে। মন্মথ কাকে সন্দেহ করছে? সতীশকে নাকি?
বিধুমুখী।
নিজের ছেলেকে যদি সন্দেহ না করবে, তবে বাপ কিসের। যদি মা হত, ছেলেকে গর্ভে ধারণ করত, তা হলে বুঝত ছেলে বলতে কী বুঝায়। গেছে তো গেছে, নাহয় সোনার গুড়গুড়িটাই গেছে আমার সতীশ কি ওঁর সোনার গুড়গুড়ির চেয়ে কম দামের।
শশধর।
সোনার গুড়গুড়ির কথা কী বলছ। সিন্দুক থেকে কী গেছে, দেখেছ নাকি।
বিধুমুখী।
হাঁ, তা -- না দেখি নি। আমি বলছি ওঁর সিন্দুকে সেই গুড়গুড়ি ছাড়া আর তো দামি জিনিস নেই -- তা সেটা যদি চুরি হয়েই থাকে, তাই বলেই কি ছেলেকে সন্দেহ।
শশধর।
তোমার সন্দেহটা কাকে, বউ।
বিধুমুখী।
কেন। ওঁর তো সেই বড়ো ভালোবাসার উড়ে বেয়ারা আছে --বনমালী। তার হাতেই তো ওঁর সব। সে হল ভারি সাধু, ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির। একটু ইশারাতেও বলো দেখি পুলিস দিয়ে তার বাক্স তল্লাস করতে, হাঁ-হাঁ করে মারতে আসবেন -- সে তো ওঁর ছেলে নয়, ওঁর বেয়ারা, তাই তার 'পরে এত ভালোবাসা।
শশধর।
কিছু মনে কোরো না বউ, আমি যাচ্ছি, ওকে বুঝিয়ে বলছি।
[ প্রস্থান
সতীশের দ্রুত প্রবেশ
সতীশ।
মা, ভয়ানক বিপদ।
বিধুমুখী।
আবার কী হল। বুকের ধড়্ধড়ানি এক মুহূর্ত থামতে দিল না।
সতীশ।
সেই যে মতি পাল, যার কাছে টাকা ধার নিয়েছিলুম, সে বাবার কাছে চিঠি দিয়ে লোক পাঠিয়েছে দেখলুম --এতক্ষণে বোধ হয় --
বিধুমুখী।
সর্বনাশ! যা, তুই রায়মশায়কে শিগগির আমার কাছে পাঠিয়ে দে, এখনো তিনি যান নি।
[ সতীশের প্রস্থান
মন্মথের প্রবেশ
মন্মথ।
এই দেখো চিঠি। পড়ে দেখো।
বিধুমুখী।
না, আমি পড়তে চাই নে।
মন্মথ।
পড়তেই হবে।
বিধুমুখী।
(চিঠি পড়িয়া) তা কী হয়েছে।
মন্মথ।
বেশি কিছু না, চুরি হয়েছে, আমার গুড়গুড়ি চুরি।
বিধুমুখী।
নিজের ছেলে নিয়েছে, তাকে বল চুরি? বলতে তোমার জিব টাক্রায় আটকে গেল না?
মন্মথ।
যে কথা বলতে জিব আটকে যাওয়া উচিত ছিল, সে কথা তুমিই বলেছ।
বিধুমুখী।
কী বলেছি।
মন্মথ।
সেই চাবি-চুরির মিথ্যে গল্প।
বিধুমুখী।
বেশ করেছি। নিজের ছেলের জন্যে বলেছি -- তার বাপের হাত থেকে তার প্রাণ বাঁচাবার জন্যে বলেছি।
মন্মথ।
প্রাণ বাঁচালেই কি বাঁচানো হল।
বিধুমুখী।
অনেক হয়েছে; আর ধর্ম-উপদেশ শুনতে চাই নে। এখন ছেলের উপর কোন্ জল্লাদি করতে চাও, খোলসা করে বলো।
মন্মথ।
পুলিসে খবর দেব।
বিধুমুখী।
দাও-না। চাবি আমার হাতে ছিল, আমিই তো চুরি করে ওকে দিয়েছি। যাক আমাকে নিয়ে জেলে, সেখানে আমি সুখে থাকব। অনেক সুখে, এর চেয়ে অনেক সুখে; মনে হবে স্বর্গে গেছি।
মন্মথ।
দরকার নেই; তোমাদের কোথাও যেতে হবে না, অনেকদিন আগেই যার যাওয়া উচিত ছিল, সে-ই একলা যাবে।
[ প্রস্থান
শশধরের প্রবেশ
শশধর।
আমাকে এ-বাড়িতে দেখলে মন্মথ ভয় পায়। ভাবে কালো কোর্তা ফরমাশ দেবার জন্য ফিতা হাতে তার ছেলের গায়ের মাপ নিতে এসেছি। ওর আবার বুকের ব্যামো, ভয় হয় পাছে আমাদের কথায় উত্তেজিত হয়ে ওর বিপদ ঘটে। যা হোক, আজ এ ব্যাপারটা কী হল। তুমি বললে চাবি-চুরি, যে-রকমটা দেখা যাচ্ছে তাতে কথাটা --
বিধুমুখী।
সবই তো শুনেছ। বলতে গেলে সতীশেরই জিনিস, ওরই আপন প্রপিতামহের। আজ বাদে কাল ওরই হাতে আসত, সেইটে নিয়েছে বলেই --
শশধর।
তা যা বল বউ, কাজটা ভালো হয় নি, ওটা চুরিই বটে।
বিধুমুখী।
তাই যদি হয়, তবে প্রপিতামহের দান সতীশকে নিতে না দিয়ে উনি সেটা তালাবন্ধ করে রেখেছেন, সেও কি চুরি নয়। এ-গুড়গুড়ি কি ওঁর আপন উপার্জনের টাকায়।
সতীশের প্রবেশ
শশধর।
কী সতীশ, খরচপত্র বিবেচনা করে কর না, এখন কী মুশকিলে পড়েছ দেখো দেখি।
সতীশ।
মুশকিল তো কিছুই দেখি নে।
শশধর।
তবে হাতে কিছু আছে বুঝি? ফাঁস কর নি।
সতীশ।
কিছু তো আছেই।
শশধর।
কত।
সতীশ।
আফিম কেনবার মতো।
বিধু।
(কাঁদিয়া উঠিয়া) সতীশ, ও কী কথা তুই বলিস, আমি অনেক দুঃখ পেয়েছি, আমাকে আর দগ্ধাস্ নে।
শশধর।
ছি ছি, সতীশ। এমন কথা যদি বা কখনো মনেও আসে, তবু কি মা'র সামনে উচ্চারণ করা যায়। বড়ো অন্যায় কথা।
সতীশ।
(জনান্তিকে) মা, তোমাকেও বলে রাখি, আমি যেমন করে পারি সেই নেক্লেসটা ফিরিয়ে এনে বাবার গুড়গুড়ি উদ্ধার করে তাঁর হাতে দিয়ে তবে এ বাড়ি থেকে ছুটি নেব। বাবার সম্পত্তি যে আমার নয়, এ কথাটা খুব স্পষ্ট করে বুঝতে পেরেছি। আর যাই হোক, আমার প্রাণটা তো আমার, এটা তো বাবার লোহার সিন্দুকে বাঁধা পড়ে নি, এটা তো রাখতেও পারি ফেলতেও পারি।
সুকুমারীর প্রবেশ
বিধুমুখী।
দিদি, সতীশকে রক্ষা করো। ও কোন্ দিন কী করে বসে। আমি তো ভয়ে বাঁচি নে। ও যা বলে, শুনে আমার গা কাঁপে।
সুকুমারী।
কী সর্বনাশ! সতীশ, আমার গা ছুঁয়ে বল্, এমন-সব কথা মনেও আনবি নে। চুপ করে রইলি যে? লক্ষ্মী বাপ আমার। তোর মা-মাসির কথা মনে করিস।
সতীশ।
জেলে বসে মনে করার চেয়ে এ-সমস্ত হাস্যকর ব্যাপার জেলের বাইরে চুকিয়ে ফেলাই ভালো।
সুকুমারী।
আমরা থাকতে তোকে জেলে কে নিয়ে যাবে।
সতীশ।
পেয়াদা।
সুকুমারী।
আচ্ছা, সে দেখব কত বড়ো পেয়াদা; ওগো, এই টাকাটা ফেলে দাও-না, ছেলেমানুষকে কেন কষ্ট দেওয়া।
শশধর।
টাকা ফেলে দিতে পারি, কিন্তু মন্মথ আমার মাথায় ইঁট ফেলে না মারে।
সতীশ।
মেসোমশাই, সে-ইঁট তোমার মাথায় পৌঁছবে না, আমার ঘাড়ে পড়বে। একে এক্জামিনে ফেল করেছি, তার উপর দেনা; এর উপরে জেলে যাবার এতবড়ো সুযোগটা যদি মাটি হয়ে যায়, তবে বাবা আমার সে-অপরাধ মাপ করবেন না।
বিধুমুখী।
সত্যি দিদি। সতীশ মেসোর টাকা নিয়েছে শুনলে তিনি বোধ হয় ওকে বাড়ি থেকে বার করে দেবেন।
সুকুমারী।
তা দিন-না। আর কি কোথাও বাড়ি নেই নাকি। ও বিধু, সতীশকে তুই আমাকেই দিয়ে দে-না। আমার তো ছেলেপুলে নেই, আমিই নাহয় ওকে মানুষ করি? কী বলো গো।
শশধর।
সে তো ভালোই। কিন্তু সতীশ যে বাঘের বাচ্ছা, ওকে টানতে গেলে তার মুখ থেকে প্রাণ বাঁচানো দায় হবে।
সুকুমারী।
বাঘমশায় তো বাচ্ছাটিকে জেলের পেয়াদার হাতেই সমর্পণ করে দিয়েছেন, আমরা যদি তাকে বাঁচিয়ে নিয়ে যাই, এখন তিনি কোনো কথা বলতে পারবেন না।
শশধর।
বাঘিনী কী বলেন; বাচ্ছাই বা কী বলে।
সুকুমারী।
যা বলে আমি জানি, সে কথা আর জিজ্ঞাসা করতে হবে না। তুমি এখন দেনাটা শোধ করে দাও।
বিধুমুখী।
দিদি!
সুকুমারী।
আর দিদি দিদি করে কাঁদতে হবে না। চল্ তোর চুল বেঁধে দিই-গে। এমন ছিরি করে তোর ভগ্নীপতির সামনে বার হতে লজ্জা করে না?
[ শশধর ব্যতীত সকলের প্রস্থান
মন্মথের প্রবেশ
শশধর।
মন্মথ, ভাই তুমি একটু বিবেচনা করে দেখো--
মন্মথ।
বিবেচনা না করে তা আমি কিছুই করি না।
শশধর।
তবে দোহাই তোমার, বিবেচনা একটু খাটো করো। ছেলেটাকে কি জেলে দেবে। তাতে কি ওর ভালো হবে।
মন্মথ।
তা জানি নে, কিন্তু যার যেটা প্রাপ্য, সে তাকে পেতেই হবে।
শশধর।
প্রাপ্যের চেয়েও বড়ো জিনিস আছে,তার 'পরেও মানুষের দাবি থাকা অন্যায় নয়।
মন্মথ।
মিথ্যে আমাকে বলছ। হয়তো সব দোষ আমারই, একলা আমারই! তার শাস্তিও যথেষ্ট পেয়েছি। এখন তোমরাই যদি সংশোধনের ভার নাও তো নাও, আমি নিষ্কৃতি নিলুম।
[ উভয়ের প্রস্থান
সতীশের বেগে প্রবেশ
সতীশ।
(উচ্চস্বরে) মা, মা!
বিধুমুখীর প্রবেশ
বিধুমুখী।
কী সতীশ, কী হয়েছে।
সতীশ।
ঠিক করেছি, যেমন করে হোক নেক্লেসটা নেলির কাছ থেকে ফিরিয়ে আনবই।
বিধুমুখী।
কী ছুতো করবি।
সতীশ।
কোনো ছুতোই না। সত্যি কথা বলব। নেলির কাছে আমি কিছু লুকোব না।
বিধুমুখী।
না না, সে কি হয়।
সতীশ।
বলব গুড়গুড়ির কথা -- বলব আমার অবস্থা কত খারাপ। আমি নেলিকে ফাঁকি দিতে পারব না।
বিধুমুখী।
সতীশ, আমার কথা শোন্, বিয়েটা আগে হোক, তার পরে সত্যি মিথ্যে যা ইচ্ছে তোর তাই বলিস।
সতীশ।
সে আমি কিছুতে পারব না। আমি জানি, নেলি একটুও মিথ্যে সইতে পারে না। আমি কিচ্ছু লুকোব না। আগাগোড়া সব বলব।
বিধুমুখী।
তার পরে?
সতীশ।
(ললাট আঘাত করিয়া) তার পরে কপাল!
তৃতীয় দৃশ্য
মিস্টার লাহিড়ির বাড়িতে টেনিস্ক্ষেত্র
নলিনী।
ও কী সতীশ, পালাও কোথায়।
সতীশ।
তোমাদের এখানে টেনিস্পার্টি জানতেম না, আমি টেনিস্সুট পরে আসি নি।
নলিনী।
জন্বুলের যত বাছুর আছে সকলেরই তো এক রঙের চামড়া হয় না, তোমার নাহয় ওরিজিন্যাল বলেই নাম রটবে। আচ্ছা, আমি তোমার সুবিধা করে দিচ্ছি। -- মিস্টার নন্দী, আপনার কাছে আমার একটা অনুরোধ আছে।
নন্দী।
অনুরোধ কেন, হুকুম বলুন-না -- আমি আপনারই সেবার্থে।
নলিনী।
যদি একেবারে অসাধ্য বোধ না করেন তা আজকের মতো আপনারা সতীশকে মাপ করবেন -- ইনি আজ টেনিস্সুট 'পরে আসেন নি। এতবড়ো শোচনীয় দুর্ঘটনা!
নন্দী।
আপনি ওকালতি করলে খুন, জাল, ঘর-জ্বালানোও মাপ করতে পারি। টেনিস্সুট না প'রে এলেই যদি আপনার এত দয়া হয়, তবে আমার এই টেনিস্সুটটা মিস্টার সতীশকে দান ক'রে তাঁর এই -- এটাকে কী বলি! তোমার এটা কী সুট, সতীশ। খিচুড়ি-সুটই বলা যাক্ -- তা আমি সতীশের এই খিচুড়ি-সুটটা পরে রোজ এখানে আসব। আমার দিকে যদি স্বর্গের সমস্ত সূর্য চন্দ্র তারা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে,তবু লজ্জা করব না। সতীশ, এ কাপড়টা দান করতে যদি তোমার নিতান্তই আপত্তি থাকে,তবে তোমার দরজির ঠিকানাটা দিয়ো। ফ্যাশানেবল ছাঁটের চেয়ে মিস লাহিড়ির দয়া অনেক মূল্যবান।
নলিনী।
শোনো, শোনো সতীশ, শুনে রাখো। কেবল কাপড়ের ছাঁট নয়, মিষ্ট কথার ছাঁদও তুমি মিস্টার নন্দীর কাছে শিখতে পার। এমন আদর্শ আর পাবে না। বিলাতে ইনি ডিউক-ডাচেস ছাড়া আর কারো সঙ্গে কথাও কন্ নি! মিস্টার নন্দী, আপনাদের সময় বিলাতে বাঙালি ছাত্র কে কে ছিল।
নন্দী।
আমি বাঙালিদের সঙ্গে সেখানে মিশি নি।
নলিনী।
শুনছ সতীশ, রীতিমত সভ্য হতে গেলে কত ছোঁওয়া বাঁচিয়ে চলতে হয়। তুমি বোধ হয় চেষ্টা করলে পারবে। টেনিস্সুট সম্বন্ধে তোমার যে-রকম সূক্ষ্ম ধর্মজ্ঞান, তাতে আশা হয়।
[ অন্যত্র গমন
সতীশ।
(দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া) নেলিকে আজ পর্যন্ত বুঝতেই পারলেম না।
চারুবালা নন্দীর কাছে আসিয়া
চারু।
মিস্টার নন্দী, সুশীলের সঙ্গে আমার একটা কথা নিয়ে ঘোর তর্ক হয়ে গেছে, আপনাকে তার নিষ্পত্তি করে দিতে হবে -- আমি বাজি রেখেছি --
নন্দী।
যদি আমার উপরেই নিস্পত্তির ভার থাকে তা হলে বাজিতে আপনি নিশ্চয়ই জিতবেন।
চারু।
না না, আগে কথাটা শুনুন -- তার পরে বিচার ক'রে--
নন্দী।
যাদের ফেথ্ নেই সেই নাস্তিকরাই সব কথা আগাগোড়া শোনে, বিচার করে -- কিন্তু মানুষের মনের মধ্যে কতকগুলি জিনিস আছে, শাস্ত্রে যাদের বলে অন্ধ। আমি দেবী-ওয়ার্শিপার, অন্ধভক্ত।
চারু।
আপনার কথা শুনলেই স্পষ্ট বুঝতে পারি, আপনি অক্স্ফোর্ডে পড়েছেন। এখন আমাদের বাজির কথাটা শুনুন। সুশীল বলতে চায়, আমার এই শাড়ির রঙের সঙ্গে আমার এই জুতোর রঙ মানায় না।
নন্দী।
সুশীল নিশ্চয় রঙকানা। আপনার শাড়ির সঙ্গে জুতোর চমৎকার ম্যাচ হয়েছে। যদি মাপ করেন তো বলি, আপনার এই রুমালটার রঙ --
চারু।
এ বুঝি আমার রুমাল? এ-যে নেলির -- সে জোর করে আমাকে দিলে -- বহরমপুরে না কোথা থেকে এই ফুলকাটা মুসলমানি ফেশানের রুমাল কিনেছে। আমাকে বললে, সাজের মধ্যে অন্তত একটা দিশি জিনিস থাক।
নন্দী।
আই সী--মিস বোস, আপনি টেনিসের নেক্স্ট্ সেটে পার্টনার ঠিক করেছেন?
চারু।
না।
নন্দী।
আমাকে যদি সিলেক্ট্ করেন, তা হলে দেখতে পাবেন, আপনার শাড়ির সঙ্গে জুতোর যে-রকম ম্যাচ হয়েছে, টেনিসে আপনার সঙ্গে আমার তার চেয়ে খারাপ ম্যাচ হবে না।
চারু।
আপনাকে পার্ট্নার পেলে তো জিতবই। আমি ভেবেছিলেম, নেক্স্ট্ সেটে আপনি বুঝি নেলির সঙ্গে এনগেজ্ড্।
নন্দী।
না, she wanted to be excused।
চারু।
ওঃ, বোধ হয় সতীশের সঙ্গে কথা আছে। আমি তো বুঝতে পারি নে সতীশের মধ্যে নলিনী কী-যে দেখেছে!
নন্দী।
দেখেছে ওর মনুমেণ্টাল অ্যাব্সার্ডিটি, আর তার চেয়ে অ্যাব্সার্ড ওর -- থাক্, সে-কথা থাক্।
চারু।
কিন্তু ওর মতো অতবড়ো অযোগ্য লোককে --
নন্দী।
অযোগ্যতা হচ্ছে শূন্যপেয়ালা, কৃপা দিয়ে ভরা সহজ।
চারু।
শুধু কেবল কৃপা! ছিঃ! শ্রদ্ধা কি তার চেয়েও বড়ো নয়। চলুন খেলতে। কিন্তু আপনি তো জানেন, আমি ভারি বিশ্রী খেলি।
নন্দী।
খেলায় আপনি হারতে পারেন, কিন্তু বিশ্রী খেলতে কিছুতেই পারেন না।
চারু।
থ্যাঙ্ক্স্।
[উভয়ের প্রস্থান
নলিনীর প্রবেশ
নলিনী।
কী সতীশ, এখনো যে তোমার মনের খেদ মিটল না। টেনিস্কোর্তার শোকে তোমার হৃদয়টা যে বিদীর্ণ হয়ে গেল। হায় হায়, কোর্তাহারা অভাগা হৃদয়ের সান্ত্বনা জগতে কোথায় আছে -- দরজির বাড়ি ছাড়া!
সতীশ।
আমার হৃদয়টার ঠিকানা যদি জানতে, তা হলে খুব বেশি দূর তাকে খুঁজে বেড়াতে হত না।
নলিনী।
(করতালি দিয়া) ব্রাভো! মিস্টার নন্দীর দৃষ্টান্তে মিষ্ট কথার আমদানি শুরু হয়েছে। উন্নতি হবে ভরসা হচ্ছে। এসো একটু কেক খেয়ে যাবে; মিষ্ট কথার পুরস্কার মিষ্টান্ন।
সতীশ।
না, আজ আর খাব না, আমার শরীরটা --
নলিনী।
সতীশ, আমার কথা শোনো -- টেনিস্কোর্তার খেদে শরীর নষ্ট কোরো না। কোর্তা জিনিসটা জগতের মধ্যে সেরা জিনিস, কিন্তু এই তুচ্ছ শরীরটা না হলে সেটা ঝুলিয়ে বেড়াবার সুবিধা হয় না।
সতীশ।
নেলি, আজ তোমাকে একটা খুব বিশেষ কথা বলতে এসেছি --
নলিনী।
না না, বিশেষ কথার চেয়ে সাধারণ কথা আমি ভালোবাসি।
সতীশ।
যেমন করে হোক বলতেই হবে, নইলে বাঁচব না, তার পরে যদি বিদায় করে দাও তবে মাথা হেঁট করে জন্মের মতোই --
নলিনী।
সর্বনাশ! সহজে বলবার কথা পৃথিবীতে এত আছে যে, চমক-লাগানো কথা না বললেও সময় কেটে যায়। আমারও বলবার কথা একটা আছে, তার পরে যদি সময় থাকে তুমি বোলো।
সতীশ।
আচ্ছা, তাই আগে বলে নাও, কিন্তু আমার কথা শুনতেই হবে।
নলিনী।
বলবার জন্যেই তোমাকে ডেকেছি, বলে নিই; রাগ কোরো না।
সতীশ।
তুমি ডেকেছ বলে রাগ করব, আমি এত বড়ো স্যাভেজ?
নলিনী।
সকল সময়েই নন্দীসাহেবের চেলাগিরি কোরো না। বলো দেখি, আমার জন্মদিনে তুমি আমাকে অমন দামি জিনিস কেন দিলে। সেই তোমার নেক্লেস?
সতীশ।
নেক্লেস? সেটা কি তবে --
নলিনী।
ভুল বুঝো না -- জিনিসটা খুব ভালো। কিন্তু তুমি যে ঐটে কেনবার জন্যে --
সতীশ।
নেলি, চুপ চুপ, তোমার মুখে আমি সে-কথা শুনতে পারব না। কে তোমাকে কী বলেছে, সব মিথ্যে কথা, মিথ্যে কথা --
নলিনী।
হঠাৎ অমন খেপে উঠলে কেন। কী মিথ্যে কথা? নেক্লেসটা তুমিই আমাকে দিয়েছ, সেও কি মিথ্যে কথা।
সতীশ।
না, না। হাঁ, তা হতেও পারে, এক রকম করে দেখলে হয়তো--
নলিনী।
নেক্লেস এক রকম করে ছাড়া আর করকম করে দেখা যায়? কথা উঠতে না উঠতেই আগে থাকতেই তুমি যেন --
সতীশ।
আচ্ছা, তা বলো, কী বলছিলে বলো।
নলিনী।
কিচ্ছু না, খুব সাদা কথা, অমন দামি জিনিস আমাকে কেন দিলে।
সতীশ।
আচ্ছা বেশ, তা হলে আমাকে ফিরিয়ে দাও।
নলিনী।
ঐ দেখো, আবার অভিমান।
সতীশ।
আমার মতো অবস্থার লোকের অভিমান কিসের। দাও তবে ফিরিয়েই দাও।
নলিনী।
অমন সুর কর যদি তোমার সঙ্গে মন খুলে কথা কওয়াই শক্ত হয়। একটু শান্ত হয়ে শোনো আমার কথা। মিস্টার নন্দী আমাকে নির্বোধের মতো একটা দামি ব্রেস্লেট পাঠিয়েছিলেন, তুমি অমনি নির্বুদ্ধিতার সুর চড়িয়ে তার চেয়ে দামি একটা নেক্লেস পাঠাতে গেলে কেন।
সতীশ।
সেটা বোঝবার শক্তি থাকলেই তো মানুষের কোনো মুশকিল ঘটে না। যে-অবস্থায় লোকের বিবেচনাশক্তি থাকে না সে-অবস্থাটা তোমার একেবারে জানা নেই বলে তুমি রাগ কর, নেলি।
নলিনী।
আমার সাত জন্মে জেনে কাজ নেই। কিন্তু ও-নেক্লেস তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
সতীশ।
ফিরে দেবে?
নলিনী।
দেব। বাহাদুরি দেখাবার জন্য যে-দান, আমার কাছে সে-দানের মূল্য নেই।
সতীশ।
বাহাদুরি দেখাবার জন্যে! এমন কথা তুমি বললে? অন্যায় বলছ, নেলি।
নলিনী।
আমি কিছুই অন্যায় বলছি নে -- তুমি যদি আমাকে একটি ফুল দিতে আমি ঢের বেশি খুশি হতেম। তুমি যখন-তখন প্রায়ই মাঝে মাঝে আমাকে কিছু-না-কিছু দামি জিনিস পাঠাতে আরম্ভ করেছ। পাছে তোমার মনে লাগে বলে আমি এতদিন কিছু বলি নি। কিন্তু ক্রমেই মাত্রা বেড়ে চলেছে, আর আমার চুপ করে থাকা উচিত নয়। এই নাও তোমার নেক্লেস।
সতীশ।
আচ্ছা, তবে নিলুম।
[ হাতে লইয়া অনেকক্ষণ নাড়াচাড়া করিয়া ধুলায় ফেলিয়া দিল
নলিনী।
ও কি হল।
সতীশ।
ভেবেছিলুম ওর দাম আছে, ওর কোনো দাম নেই।
নলিনী।
(তুলিয়া লইয়া) তুমি রাগই কর আর যাই কর, আমার যা বলবার তোমাকে বলবই। আমি তো তোমাকে ছেলেবেলা থেকেই জানি, আমার কাছে ভাঁড়িয়ো না। সত্য করে বলো, তোমার কি অনেক টাকা ধার হয় নি।
সতীশ।
(চমকিয়া উঠিয়া) কে বললে ধার হয়েছে। কে বললে তোমাকে। একজন কেউ আছে, সে লাগালাগি করছে। তার নাম বলো; আমি তাকে--
নলিনী।
আজ তোমার কী হয়েছে বলো তো।
সতীশ।
বলতেই হবে তোমাকে কে বলেছে আমার ধারের কথা। আমি তাকে দেখে নিতে চাই।
নলিনী।
কেউ বলে নি। আমি তোমার মুখ দেখেই বুঝতে পারি। আমার জন্য তুমি এমন অন্যায় কেন করছ।
সতীশ।
সময়বিশেষে লোকবিশেষের জন্যে মানুষ প্রাণ দিতে ইচ্ছে করে; আজকালকার দিনে প্রাণ দেবার ভদ্র উপায় খুঁজে পাওয়া যায় না -- অন্তত ধার করার দুঃখটুকু স্বীকার করবার যে-সুখ তাও কি ভোগ করতে দেবে না। আমার পক্ষে যা মৃত্যুর চেয়েও দুঃসাধ্য, আমি তোমার জন্য তাই করতে চাই নেলি, একে যদি তুমি নন্দীসাহেবের নকল বল, তবে আমার পক্ষে মর্মান্তিক হয়।
নলিনী।
আচ্ছা, তোমার যা করবার তা তো করেছ -- তোমার সেই ত্যাগ-স্বীকারটুকু আমি নিলেম -- এখন এ-জিনিসটা ফিরে নাও।
সতীশ।
তবে দাও, তাই দাও। যদি আমার অন্তরের কথাটা বুঝে থাক, তা হলে --
নলিনী।
থাক্ থাক্, অন্তরের কথা অন্দরমহলেই থাক্। নেক্লেসটা এই নিয়ে যাও।
সতীশ।
(হাতে লইয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া) সেই ভালো, তবে যাই। (কিছু দূর গিয়া ফিরিয়া আসিয়া) দয়া করো নেলি, দয়া করো -- যদি আমাকে ফিরিয়ে নিতে হয়, তবে ওটা গলায় ফাঁস লাগিয়ে দম বন্ধ করে আমার পক্ষে মরা ভালো।
নলিনী।
দেনা তুমি শোধ করবে কী করে।
সতীশ।
মার কাছ থেকে টাকা পাব।
নলিনী।
ছি ছি, তিনি মনে করবেন, আমার জন্যই তাঁর ছেলের দেনা হচ্ছে। সতীশ, তোমার এই নেক্লেসটা হাতে করে নেওয়ার চেয়ে ঢের বেশি করে নিয়েছি, এই কথাটা তোমাকে বুঝে দেখতে হবে। নইলে কখনোই তোমাকে ফিরিয়ে দিতে পারতুম না। দিলে অপমান করা হত। বুঝতে পারছ?
সতীশ।
সম্পূর্ণ না।
নলিনী।
তোমার দান-করাকেই আমি বেশি মান দিয়েছি বলেই তোমার দানের জিনিসকে অনায়াসে ত্যাগ করতে পারি। মনে করো না, এটা হারিয়ে গেছে; সেই হারানোতে তোমার দান তো একটুও হারায় না।
সতীশ।
ঠিক বলছ, নেলি?
নলিনী।
ঠিক বলছি। আমি যেমন সহজে এটি তোমার হাতে ফিরিয়ে দিচ্ছি, তেমনি সহজে তুমি এটি আমার হাত থেকে ফিরে নাও। তা হলে আমি ভারি খুশি হব।
সতীশ।
খুশি হবে? তবে দাও। (নেক্লেস লইয়া) কিন্তু যে-হাত দিয়ে তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিলে, সেই হাতেই তুমি আর-একজনের ব্রেস্লেট পরেছ, সে যেন আমাকে --
নলিনী।
ওতে কন্যার হাত নেই সতীশ, আছে কন্যাকর্তার হাত। বাবা বিশেষ করে বলেছিলেন, আজ --
সতীশ।
আচ্ছা, ঐ ব্রেস্লেট চিরদিনই তোমার হাতে থাক্-- এই নেক্লেস কেবল কিছুক্ষণের জন্যে গলায় পরো, তার পরে আমি নিয়ে যাব।
নলিনী।
পরলে বাবা রাগ করবেন।
সতীশ।
কেন।
নলিনী।
তা হলে এই ব্রেস্লেট পরার দাম কমে যাবে -- ফের মুখ গম্ভীর করছ?
সতীশ।
কথাটা কি খুব প্রফুল্ল হবার মতো।
নলিনী।
নয় তো কী। তোমার কাছে যে আমি এত খুলে কথা বলি, তার কোনো দাম নেই? অকৃতজ্ঞ! মিস্টার নন্দীর সঙ্গে আমি এমন করে কইতে পারতুম? এবার কিন্তু টেনিস্কোর্ট্ থেকে যাও।
সতীশ।
কেন যেতে বলছ, নেলি। এখানে আমাকে মানায় না?
নলিনী।
না, মানায় না।
সতীশ।
চাঁদনির কাপড় পরি বলে?
নলিনী।
সে একটা কারণ বৈকি।
সতীশ।
তুমি আমাকে এমন কথা বললে?
নলিনী।
আমি যদি তোমাকে সত্যি কথা বলি, খুশি হোয়ো, অন্যে বললে রাগ করতে পার।
সতীশ।
তুমি আমাকে অযোগ্য বলে জান, এতে আমি খুশি হব?
নলিনী।
এই টেনিস্কোর্টের অযোগ্যতাকে তুমি অযোগ্যতা বলে লজ্জা পাও? এতেই আমি সব চেয়ে লজ্জা বোধ করি। তুমি তো তুমি, এখানে স্বয়ং বুদ্ধদেব এসে যদি দাঁড়াতেন, আমি দুই হাত জোড় করে পায়ের ধুলো নিয়েই তাঁকে বলতুম, ভগবান, লাহিড়িদের বাড়ির এই টেনিস্কোর্টে আপনাকে মানায় না, মিস্টার নন্দীকে তার চেয়ে বেশি মানায়। শুনে কি তখনই তিনি হার্মানের বাড়ি ছুটতেন টেনিস্সুট অর্ডার দিতে।
সতীশ।
বুদ্ধদেবের সঙ্গে --
নলিনী।
তোমার তুলনাই হয় না, তা জানি। আমি বলতে চাই, টেনিস্কোর্টের বাইরেও একটা মস্ত জগৎ আছে -- সেখানে চাঁদনির কাপড় পরেও মনুষ্যত্ব ঢাকা পড়ে না। এই কাপড় পরে যদি এখনই ইন্দ্রলোকে যাও তো উর্বশী হয়তো একটা পারিজাতের কুঁড়ি ওর বাট্ন্হোলে পরিয়ে দিতে কুণ্ঠিত হবে না -- অবিশ্যি তোমাকে যদি তার পছন্দ হয়।
সতীশ।
বাট্ন্হোল তো এই রয়েছে, গোলাপের কুঁড়িও তোমার খোঁপায়--এবারে পছন্দর পরিচয়টা কি ভিক্ষে করে নিতে পারি।
নলিনী।
আবার ভুলে যাচ্ছ, এটা স্বর্গ নয়, এটা টেনিস্কোর্ট।
সতীশ।
এটা যে স্বর্গ নয়, সেইটে ভুলতে পারি নে বলেই তো--
নলিনী।
এইবার তো নন্দীর সুর লাগছে গলায় --
সতীশ।
তার একটিমাত্র কারণ -- আমি টেনিস্কোর্টেরই যোগ্য হতে চাই। উর্বশীর হাতের পারিজাতের কুঁড়ির 'পরে আমার একটুও লোভ নেই।
নলিনী।
বড়ো দুঃসাধ্য তোমার তপস্যা, সতীশ -- স্বর্গে তোমার কম্পিটিশন কার্তিককে নিয়ে, চাঁদকে নিয়ে -- এখানে আছেন স্বয়ং মিস্টার নন্দী। পেরে উঠবে না, কন্যাকর্তাদের সব দামি দামি অর্কিড ওঁরই বাট্ন্হোলে গিয়ে পৌঁচচ্ছে। ছেড়ে দাও আশা।
সতীশ।
অর্কিডের আশা ছেড়েছি, কিন্তু ঐ গোলাপের কুঁড়ি --
নলিনী।
ওটা বাবা যখন দোকান থেকে আনিয়ে দিয়েছিলেন, তখন কামনা করেছিলেন, ওর সদগতি হয় যেন --
সতীশ।
অর্থাৎ --
নলিনী।
ঐ অর্থাতের মধ্যে অনেকখানি অর্থ আছে।
সতীশ।
আর আমি যে তোমার স্তব করে মরি, তার মধ্যে যতটা শব্দ আছে ততটা অর্থ নেই?
নলিনী।
যদি কিছু থাকে, সে কন্যাকর্তাদের অমরলোকের উপযুক্ত নয়।
সতীশ।
অতএব আমাকে সদ্য স্বর্গপ্রাপ্তির চেষ্টা করতে হবে। চললেম তবে সেই তপস্যায়।
নন্দীর প্রবেশ
নন্দী।
হ্যালো সতীশবাবু! ও কী ও! সেই নেক্লেসটা নিয়ে চলেছ যে! সেদিন তো অ্যাল্বম নিয়ে সরে পড়েছিলে, আজ নেক্লেস? Bravo! You know how to eat your pudding and yet to keep it।
সতীশ।
বুঝতে পারছি নে আপনার কথা।
নন্দী।
আমরা যা দিই তা ফিরে নিই নে, তার বদলেও কিছু ফিরে পাই নে। দেবার হাত, নেবার হাত, দুই হাতই খালি থাকে।You are lucky, বিনা মূলধনে ব্যাবসা ক'রে এত এনর্মাস প্রফিট।
নলিনী।
ও কী সতীশ, হাতের আস্তিন গুটোচ্ছ যে, মারামারি করবে নাকি। তা হলে মাঝের থেকে আমার নেক্লেসটা ভাঙবে দেখছি। দাও ওটা গলায় পরে নিই। --
[ নেক্লেস লইয়া গলায় পরা
অমনি নেব না, সতীশ, এর দাম দেব। --
[ গোলাপের কুঁড়ি সতীশের বাট্ন্হোলে পরাইয়া
মিস্টার নন্দী, আপনার ব্রেস্লেট আপনি নিয়ে যান।
নন্দী।
কেন।
নলিনী।
এর দাম আমার কাছে নেই।
নন্দী।
বিনা দামেই তো আমি --
নলিনী।
আপনার খুব দয়া। কিন্তু আমার তো আত্মসম্মান আছে। এসো সতীশ, তোমাদের দুজনের লড়াই দেখবার সময় আমার নেই। তার চেয়ে এসো বেড়াতে বেড়াতে গল্প করি, সময়টা কাটবে ভালো।
[ উভয়ের প্রস্থান
চারুবালার প্রবেশ
চারু।
মিস্টার নন্দী, আপনার নৈবেদ্য দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু সামনে দেবতা নেই যে।
নন্দী।
কে বললে নেই।
চারু।
সাকার দেবতার কথা বলছি, নিরাকারের খবর জানি নে।
নন্দী।
পূজা যদি নেন, তা হলে করকমলে --
চারু।
আপনি মাঝে মাঝে চোখে ভুল দেখেন নাকি। আমি তো--
নন্দী।
হাঁ, ভুল ঠিকানায় গিয়ে পৌঁছই --
চারু।
তার পরে রিডাইরেক্টড্ হয়ে --
নন্দী।
ঘুরে আসতে হয়।
চারু।
আজ আপনার কপালে তারই ছাপ দেখতে পাচ্ছি।
নন্দী।
ছাপের সংখ্যা আর বাড়াবেন না, তা হলে কলঙ্কের চিহ্নটাই জাগবে; ঠিকানাটাই পড়বে চাপা।
চারু।
আপনার মতো আলাপ করতে আমি কাউকে শুনি নি -- চমৎকার কথা কইতে পারেন।
নন্দী।
শুধু যে কেবল কানে শোনার কথাই আমার সম্বল, তা নয়, হাতে সোনাও জোগাতে পারি, এইটে প্রমাণ করতে দিন।
চারু।
আপনি বাংলাতেও punকরতে পারেন -- ক্ষমতা আছে। কিন্তু মিস্টার নন্দী, ও ব্রেস্লেট তো নেলির --
নন্দী।
সেইটেই তো হয়েছিল মস্ত ভুল। শোধরাবার অপর্চুনিটি যদি না দেন, তা হলে উদ্ধার হবে কী করে।
চারু।
ঐ নেলি আসছে, চলুন আমরা ঐদিকে যাই।
[ উভয়ের প্রস্থান
নলিনী ও সতীশের প্রবেশ
নলিনী।
যথেষ্ট হয়েছে সতীশ, আজ যদি মিষ্টি কথা বলবার চেষ্টা কর তা হলে কিন্তু রসভঙ্গ হবে।
সতীশ।
আচ্ছা, আমাকে যদি একেবারে চুপ করিয়ে রাখতে চাও, তা হলে ঐ গানটা আমাকে শোনাও।
নলিনী।
কোন্টা।
সতীশ।
সেই যে -- উজাড় করে দাও হে আমার সকল সম্বল।
নলিনীর গান
উজাড় করে লও হে আমার সকল সম্বল।
শুধু ফিরে চাও ফিরে চাও ওহে চঞ্চল।
চৈত্ররাতের বেলায়
নাহয় এক প্রহরের খেলায়
আমার স্বপনস্বরূপিণী প্রাণে দাও পেতে অঞ্চল।
যদি এই ছিল গো মনে,
যদি পরমদিনের স্মরণ ঘুচাও চরম অযতনে,
তবে ভাঙা খেলার ঘরে
নাহয় দাঁড়াও ক্ষণেক তরে,
ধুলায় ধুলায় ছড়াও হেলায় ছিন্ন ফুলের দল।
লাহিড়িসাহেবের প্রবেশ
লাহিড়ি।
নেলি, এই দিকে এসো। শুনে যাও। (জনান্তিকে) সতীশের বাপ মারা গেছেন।
নলিনী।
সে কী কথা।
লাহিড়ি।
মাদ্রাজে। সেও আজ তিন দিন হল। হার্টের উইক্নেস থেকে।
নলিনী।
সতীশ জানে না?
লাহিড়ি।
না -- মন্মথ বাড়ির লোককে কাছে ডাকতে মানা করেছিলেন। সেখানে ওঁর বাড়ির ঠিকানাও কেউ জানত না। দৈবাৎ পুজোর ছুটিতে একজন বাঙালি উকিল সেখানে ছিল, মৃত্যুশয্যায় সেই তাঁর উইল তৈরি করেছে। সে আজ এসে পৌঁচেছে। আমাকে সে জানে -- আমার কাছেই প্রথম এসেছিল, আমি মন্মথর বাড়িতে তাকে এইমাত্র রওনা করে দিলুম। তুমি সতীশকে শীঘ্র সেখানে পাঠিয়ে দাও।
[প্রস্থান
নলিনী।
সতীশ, চা পড়ে রয়েছে, খেয়ে নাও।
সতীশ।
আমার ইচ্ছে করছে না।
নলিনী।
আমার কথা শোনো, শুধু চা নয়, কিছু খাও। এই নাও রুটি।
সতীশ।
মনে রেখো নেলি, গরিব বলেই আমার দানের দাম অনেক বেশি।
নলিনী।
দেখো, ও-কথা আজ থাক্। কাল হবে। এখন তুমি খেয়ে নাও।
সতীশ।
তাড়া দিচ্ছ কেন -- আমার তো আপিস নেই।
নলিনী।
চুপ চুপ, কথা কোয়ো না, খাও। আরেকটু খাও। এই নাও।
সতীশ।
আর পারছি নে -- আমার হয়েছে। আমার খাবার রুচি চলে গেছে।
নলিনী।
আচ্ছা, তা হলে এসো -- শোনো। তোমাকে দরজা পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিই।
সতীশ।
আমার এমন সৌভাগ্য তো আর কখনো --
নলিনী।
চুপ চুপ। চলে এসো।
[ উভয়ের প্রস্থান
লাহিড়ি ও লাহিড়ি-জায়ার প্রবেশ
লাহিড়ি-জায়া।
সতীশের বাপ হঠাৎ মারা গেছে?
লাহিড়ি।
হাঁ।
জায়া।
কে যে বললে সমস্ত সম্পত্তি অনাথ-আশ্রমে দিয়ে গেছে, কেবল সতীশের মার জন্য জীবিতকাল পর্যন্ত ৭৫ টাকা মাসহারা বরাদ্দ। এখন কী করা যায়!
লাহিড়ি।
এত ভাবনা কেন তোমার।
জায়া।
বেশ লোক যা হোক তুমি। তোমার মেয়ে যে সতীশকে ভালোবাসে, সেটা বুঝি তুমি দুই চক্ষু খেয়ে দেখতে পাও না। তোমার নেলি এ দিকে লঙ্কার ধোঁয়া দিয়ে নন্দীকে দেশছাড়া করে দিয়েছে। নন্দী তো ভয়ে ওর কাছেই ঘেঁষতে চায় না। জানো বোধ হয় চারুর সঙ্গে সে এন্গেজ্ড্।
লাহিড়ি।
সেদিন টেনিস্কোর্টেই সেটা বোঝা গিয়েছিল।
জায়া।
এখন উপায় কী করবে।
লাহিড়ি।
আমি তো মন্মথর টাকার উপর কোনোদিন নির্ভর করি নি।
জায়া।
তবে কি ছেলেটির উপর নির্ভর করে বসেছিলে। অন্নবস্ত্রটা বুঝি অনাবশ্যক?
লাহিড়ি।
সম্পূর্ণ আবশ্যক। সতীশের একটি মেসো আছে বোধ হয় জান।
জায়া।
মেসো তো ঢের লোকেরই থাকে; তাতে ক্ষুধাশান্তি হয় না।
লাহিড়ি।
এই মেসোটি আমার মক্কেল -- অগাধ টাকা। ছেলেপুলে কিছুই নেই -- বয়সও নিতান্ত অল্প নয়। সে তো সতীশকেই পোষ্যপুত্র নিতে চায়।
জায়া।
মেসোটি তো ভালো। তা চটপট নিক্-না। তুমি একটু তাড়া দাও-না।
লাহিড়ি।
তাড়া আমাকে দিতে হবে না, তার ঘরের মধ্যেই তাড়া দেবার লোক আছে। সবই প্রায় ঠিকঠাক, এখন কেবল একটা আইনের খটকা উঠেছে -- এক ছেলেকে পোষ্যপুত্র লওয়া যায় কি না -- তা ছাড়া সতীশের আবার বয়স হয়ে গেছে।
জায়া।
আইন তো তোমাদেরই হাতে -- তোমরা চোখ বুজে একটা বিধান দিয়ে দাও-না।
লাহিড়ি।
ব্যস্ত হোয়ো না -- পোষ্যপুত্র না নিলেও অন্য উপায় আছে।
জায়া।
আমাকে বাঁচালে। আমি ভাবছিলেম সম্বন্ধ ভাঙি কী করে। আবার আমাদের নেলি যে-রকম জেদালো মেয়ে, সে যে কী করে বসত বলা যায় না। কিন্তু তাই বলে গরিবের হাতে তো মেয়ে দেওয়া যায় না। ঐ দেখো, তোমার মেয়ে কেঁদে চোখ ফুলিয়েছে।
লাহিড়ি।
কিন্তু নেলি যে সতীশকে ভালোবাসে, সে তো দেখে মনে হয় না। ও তো সতীশকে নাকের জলে চোখের জলে করে। এক সময় আমি ভাবতুম, নন্দীর ওপরেই ওর বেশি টান।
জায়া।
তোমার মেয়েটির ঐ স্বভাব -- সে যাকে ভালোবাসে তাকেই জ্বালাতন করে। দেখো-না বিড়ালছানাটাকে নিয়ে কী কাণ্ডটাই করে। কিন্তু আশ্চর্য এই, তবু তো ওকে কেউ ছাড়তে চায় না।
নলিনীর প্রবেশ
নলিনী।
মা, একবার সতীশবাবুর বাড়ি যাবে না? তাঁর মা বোধ হয় খুব কাতর হয়ে পড়েছেন। বাবা, আমি একবার তাঁর কাছে যেতে চাই।
চতুর্থ দৃশ্য
শশধরের ঘর: সম্মুখেই বাগান
সতীশ।
বাবার শাপ এখনো ছাড়ে নি মা, এখনো ছাড়ে নি। তিনি আমার ভাগ্যের উপরে এখনো চেপে বসে আছেন।
বিধুমুখী।
আমাদের যা করবার তা তো করেছি, গয়াতে তাঁর সপিণ্ডীকরণ হয়ে গেল -- তোর মাসির কল্যাণে ব্রাক্ষ্ণণবিদায়েরও ভালো আয়োজন হয়েছিল।
সতীশ।
সেই পুণ্যফল মাসির কপালেই ফলল। নইলে --
বিধুমুখী।
তাই তো। নইলে এত বয়সে তাঁর ছেলে হবে, এমন সর্বনেশে কথা স্বপ্নেও ভাবি নি।
সতীশ।
অন্যায় অন্যায়! বাবার সম্পত্তি পেতে পারতুম, তার থেকে বঞ্চিত হলুম; তার পরে আবার -- কী অন্যায়।
বিধুমুখী।
অন্যায় নয় তো কী। নিজের বোনপোকে এমন করেও ঠকালে? শেষকালে দয়ালডাক্তারের ওষুধ তো খাটল; আমরা কালীঘাটে এত মানত করলুম, তার কিছুই হল না। একেই বলে কলিকাল। একমনে ভগবানকে ডাক্ -- তিনি যদি এখনো --
সতীশ।
মা, এঁদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞ থাকা উচিত ছিল -- কিন্তু যে-রকম অন্যায় হল, তাতে -- ঈশ্বরের কাছে -- তিনি দয়া করে যেন --
বিধুমুখী।
আহা, তাই হোক -- নইলে তোর উপায় কী হবে, সতীশ। হে ভগবান, তুমি যেন --
সতীশ।
এ যদি না হয় ঈশ্বরকে আমি আর মানব না; কাগজে নাস্তিকতা প্রচার করব। কে বলে তিনি মঙ্গলময়।
বিধুমুখী।
আরে চুপ চুপ, এখন অমন কথা মুখে আনতে নেই। তিনি দয়াময়, তাঁর দয়া হলে কী না ঘটতে পারে। -- সতীশ, আজ বুঝি ওদের ওখানে যাচ্চিস?
সতীশ।
হাঁ।
বিধুমুখী।
তোর সেই সাহেবের দোকানের কাপড় পরিস্ নি যে বড়ো?
সতীশ।
সে-সব পুড়িয়ে ফেলেছি।
বিধুমুখী।
সে আবার কবে হল।
সতীশ।
অনেক দিন। টেনিস্পার্টিতে নলিনীকে কথা দিয়ে এসেছিলেম।
বিধুমুখী।
সে যে অনেক দামের!
সতীশ।
নইলে পোড়াবার মজুরি পোষাবে কেন। স্বর্ণলঙ্কারও তো অনেক দাম ছিল।
বিধুমুখী।
তোমাদের বোঝা আমার কর্ম নয়। যাই, দিদির খোকাকে নাওয়াতে হবে।
[ প্রস্থান
সুকুমারীর প্রবেশ
সুকুমারী।
সতীশ!
সতীশ।
কী মাসিমা।
সুকুমারী।
কাল যে তোমাকে খোকার কাপড় কিনে আনবার জন্য এত করে বললেম, অপমান বোধ হল বুঝি!
সতীশ।
অপমান কিসের, মাসিমা। কাল লাহিড়িসাহেবের ওখানে আমার নিমন্ত্রণ ছিল, তাই --
সুকুমারী।
লাহিড়িসাহেবের ওখানে তোমার এত ঘন ঘন যাতায়াতের দরকার কী তা তো ভেবে পাই নে। তারা সাহেব মানুষ; তোমার মতো অবস্থার লোকের কি তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা সাজে। আমি তো শুনলেম, তোমাকে তারা পোঁছে না, তবু বুঝি ঐ রঙিন টাইয়ের উপর টাইরিঙ পরে বিলাতি কার্তিক সেজে তাদের ওখানে আনাগোনা করতেই হবে! তোমার কি একটুও সম্মানবোধ নেই। এ দিকে একটা কাজ করতে বললে মনে মনে রাগ করা হয়, পাছে ওঁকে কেউ বাড়ির সরকার মনে ক'রে ভুল করে। কিন্তু সরকারও তো ভালো -- সে খেটে উপার্জন ক'রে খায়।
সতীশ।
মাসিমা, আমিও হয়তো অনেক আগেই তা পারতেম, কিন্তু তুমিই তো --
সুকুমারী।
তাই বটে! জানি,শেষকালে আমারই দোষ হবে। এখন বুঝছি, তোমার বাপ তোমাকে ঠিক চিনতেন। আমি আরো ছেলেমানুষ বলে দয়া করে তোমাকে ঘরে স্থান দিলেম, জেল থেকে বাঁচালেম, শেষকালে আমারই যত দোষ হল। একেই বলে কৃতজ্ঞতা! আচ্ছা, আমারই নাহয় যত দোষ, তবু যে-কদিন এখানে আমাদের অন্ন খাচ্ছ, দরকারমতো দুটো কাজই নাহয় করে দিলে। এমন কি কেউ করে না। এতে কি অত্যন্ত অপমান বোধ হয়।
সতীশ।
কিছু না, কিছু না, কী করতে হবে বলো, আমি এখনই করছি।
সুকুমারী।
আজ তোমার আপিসের ছুটি আছে, তোমাকে দোকানে যেতে হবে। খোকার জন্য সাড়ে সাত গজ রেন্বো সিল্ক চাই -- আর একটা সেলার সুট।
[ সতীশ প্রস্থানোদ্যম
শোনো শোনো, ওর মাপটা নিয়ে যেয়ো। জুতো চাই। --
[সতীশ প্রস্থানোন্মুখ
অত ব্যস্ত হচ্ছ কেন -- সবগুলো ভালো করে শুনেই যাও। আজও বুঝি লাহিড়ি সাহেবের রুটি-বিস্কিট খেতে যাবার জন্য প্রাণ ছট্ফট্ করছে? খোকার জন্য স্ট্র-হ্যাট এনো -- আর তার রুমালও এক ডজন চাই। --
[সতীশের প্রস্থান। পুনরায় ডাকিয়া
শোনো সতীশ, আর-একটা কথা আছে। শুনলেম তোমার মেসোর কাছ থেকে তুমি নূতন সুট কেনবার জন্য আমাকে না বলে টাকা চেয়ে নিয়েছ। যখন নিজের সামর্থ্য হবে তখন যত-খুশি সাহেবিয়ানা কোরো, কিন্তু পরের পয়সায় লাহিড়িসাহেবদের তাক লাগিয়ে দেবার জন্য মেসোকে ফতুর করে দিয়ো না। সে-টাকাটা আমাকে ফেরত দিয়ো। আজকাল আমাদের বড়ো টানাটানির সময়।
সতীশ।
আচ্ছা, এনে দিচ্ছি।
সুকুমারী।
এখনো দোকান খুলতে দেরি আছে। কিন্তু টাকা বাকি যা থাকে, ফেরত দিয়ো যেন। একটা হিসাব রাখতে ভুলো না। --
[সতীশের প্রস্থানোদ্যম
শোনো সতীশ, এই কটা জিনিস কিনতে আবার যেন আড়াইটাকা গাড়িভাড়া লাগিয়ে বোসো না। ঐজন্যে তোমাকে কিছু আনতে বলতে ভয় করে। দুপা হেঁটে চলতে হলেই অমনি তোমার মাথায়-মাথায় ভাবনা পড়ে -- পুরুষমানুষ এত বাবু হলে তো চলে না। তোমার বাবা রোজ সকালে নিজে হেঁটে গিয়ে নতুনবাজার থেকে মাছ কিনে আনতেন -- মনে আছে তো? মুটেকেও তিনি এক পয়সা দেন নি।
সতীশ।
তোমার উপদেশ মনে থাকবে -- আমিও দেব না। আজ হতে তোমার এখানে মুটেভাড়া, বেহারার মাইনে, যত অল্প লাগে সে দিকে আমার সর্বদাই দৃষ্টি থাকবে --
[ সুকুমারীর প্রস্থান
সেই চিঠিটা এইবেলা শেষ করি, নইলে সময় পাব না।
[ চিঠি লিখিতে প্রবৃত্ত
হরেনের প্রবেশ
হরেন।
দাদা, ও কী লিখছ, কাকে লিখছ, বলো-না।
সতীশ।
যা যা, তোর সে-খবরে কাজ কী, তুই খেলা কর্গে যা।
হরেন।
দেখি-না কী লিখছ -- আমি আজকাল পড়তে পারি।
সতীশ।
হরেন, তুই আমাকে বিরক্ত করিস নে বলছি -- যা তুই।
হরেন।
ভয়ে আকার ভা, ল, ভাল, বয়ে আকার বা, সয়ে আকার সা --ভালোবাসা। দাদা, কী ভালোবাসার কথা লিখছ, বলো-না। কাঁচা পেয়ারা?
সতীশ।
আঃ হরেন, অত চেঁচাস নে। ভালোবাসার কথা আমি লিখি নি।
হরেন।
অ্যাঁ, মিথ্যা কথা বলছ! ভয়ে আকার ভা, ল, ভাল, বয়ে আকার সয়ে আকার -- ভালোবাসা। আচ্ছা, মাকে ডাকি, তাঁকে দেখাও।
সতীশ।
না না, মাকে ডাকতে হবে না। লক্ষ্মীটি, তুই একটু খেলা করতে যা, আমি এইটে শেষ করি।
হরেন।
এটা কী, দাদা। এ-যে ফুলের তোড়া। আমি নেব।
সতীশ।
ওতে হাত দিস্ নে -- হাত দিস্ নে, ছিঁড়ে ফেলবি।
হরেন।
না, আমি ছিঁড়ে ফেলব না, আমাকে দাও-না।
সতীশ।
খোকা, কাল তোকে অনেক তোড়া এনে দেব, এটা থাক্।
হরেন।
দাদা, এটা বেশ, আমি এইটেই নেব।
সতীশ।
না, এ আর-একজনের জিনিস, আমি তোকে দিতে পারব না।
হরেন।
অ্যাঁ, মিথ্যে কথা। আমি তোমাকে লজঞ্জুস আনতে বলেছিলেম, তুমি সেই টাকায় তোড়া এনেছ -- তাই বৈকি, আরেকজনের জিনিস বৈকি!
সতীশ।
হরেন, লক্ষ্মী ভাই, একটুখানি চুপ কর্, চিঠিখানা শেষ করে ফেলি। কাল তোকে আমি অনেক লজঞ্জুস কিনে এনে দেব।
হরেন।
আচ্ছা, তুমি কী লিখছ আমাকে দেখাও।
সতীশ।
আচ্ছা, দেখাব, আগে লেখাটা শেষ করি।
হরেন।
তবে আমিও লিখি। (স্লেট লইয়া চীৎকারস্বরে) ভয়ে আকার ভা--
সতীশ।
চুপ চুপ, অত চীৎকার করিস্ নে। -- আঃ, থাম্ থাম্।
হরেন।
তবে আমাকে তোড়াটা দাও।
সতীশ।
আচ্ছা নে, খবরদার ছিঁড়িস্ নে। -- ও কী করলি। যা বারণ করলেম তাই, ফুলটা ছিঁড়ে ফেললি। এমন বদ ছেলেও তো দেখি নি। (তোড়া কাড়িয়া লইয়া চপেটাঘাত করিয়া) লক্ষ্মীছাড়া কোথাকার! যা এখান থেকে -- যা বলছি! যা!
[হরেনের চীৎকারস্বরে ক্রন্দন ও সতীশের সবেগে প্রস্থান
বিধুমুখীর ব্যস্ত হইয়া প্রবেশ
বিধুমুখী।
সতীশ বুঝি হরেনকে কাঁদিয়েছে, দিদি টের পেলে সর্বনাশ হবে হরেন, বাপ আমার, কাঁদিস্ নে, লক্ষ্মী আমার, সোনা আমার।
হরেন।
(সরোদনে) দাদা আমাকে মেরেছে।
বিধুমুখী।
আচ্ছা, চুপ কর্, চুপ কর্, আমি দাদাকে খুব করে মারব এখন।
হরেন।
দাদা ফুলের তোড়া কেড়ে নিয়ে গেল।
বিধুমুখী।
আচ্ছা, সে আমি তার কাছ থেকে নিয়ে আসছি। -- [হরেনের ক্রন্দন] এমন ছিঁচকাঁদুনে ছেলেও তো আমি কখনো দেখি নি। দিদি আদর দিয়ে ছেলেটির মাথা খাচ্ছেন। যখন যেটি চায় তখন সেটি তাকে দিতে হবে। দেখো-না, একেবারে নবাবপুত্র! ছি ছি, নিজের ছেলেকে কি এমনি করেই মাটি করতে হয়। (সতর্জনে) খোকা, চুপ কর্ বলছি, ঐ হাম্দোবুড়ো আসছে।
সুকুমারীর প্রবেশ
সুকুমারী।
বিধু, ও কী ও! আমার ছেলেকে কি এমনি করেই ভূতের ভয় দেখাতে হয়। আমি চাকর-বাকরদের বারণ করে দিয়েছি, কেউ ওর কাছে ভূতের কথা বলতে সাহস করে না। -- আর, তুমি বুঝি মাসি হয়ে ওর এই উপকার করতে বসেছ। কেন বিধু, আমার বাছা তোমার কী অপরাধ করেছে। ওকে তুমি দুটি চক্ষে দেখতে পার না, তা আমি বেশ বুঝেছি। আমি বরাবর তোমার ছেলেকে পেটের ছেলের মতো মানুষ করলেম আর তুমি বুঝি আজ তারই শোধ নিতে এসেছ।
বিধুমুখী।
(সরোদনে) দিদি, এমন কথা বোলো না। আমার কাছে সতীশ আর তোমার হরেনে প্রভেদ কী আছে।
হরেন।
মা, দাদা আমাকে মেরেছে।
বিধুমুখী।
ছি ছি খোকা, মিথ্যা বলতে নেই। দাদা তোর এখানে ছিলই না, তা মারবে কী করে।
হরেন।
বাঃ, দাদা যে এইখানে বসে চিঠি লিখছিল -- তাতে ছিল ভয়ে আকার ভা, ল, ভাল।
সুকুমারী।
তোমরা মায়ে-পোয়ে মিলে আমার ছেলের সঙ্গে লেগেছ বুঝি। ওকে তোমাদের সহ্য হচ্ছে না! ও গেলেই তোমরা বাঁচ। আমি তাই বলি, খোকা রোজ ডাক্তার কব্রাজের বোতল-বোতল ওষুধ গিলছে, তবু দিন-দিন এমন রোগা হচ্ছে কেন। ব্যাপারখানা আজ বোঝা গেল।
[সকলের প্রস্থান
সতীশ ও নলিনীর প্রবেশ
সতীশ।
এ কী, তুমি যে এ-বাড়িতে?
নলিনী।
শশধরবাবু বাবাকে কী একটা আইনের কাজে ডেকেছেন। আমি তাঁর সঙ্গে এসেছি।
সতীশ।
আমি তোমার কাছে শেষ বিদায় নিতে চাই, নেলি।
নলিনী।
কেন, কোথায় যাবে।
সতীশ।
জাহান্নমে।
নলিনী।
যে-লোক সন্ধান জানে সে-তো ঘরে বসেই সেখানে যেতে পারে। আজ তোমার মেজাজটা এমন কেন। কলারটা বুঝি ঠিক হাল ফেশানের হয় নি!
সতীশ।
তুমি কি মনে কর, আমি কেবল কলারের কথাই দিনরাত্রি চিন্তা করি।
নলিনী।
তাই তো মনে হয়। সেইজন্যই তো হঠাৎ তোমাকে অত্যন্ত চিন্তাশীলের মতো দেখায়।
সতীশ।
ঠাট্টা কোরো না নেলি, তুমি যদি আজ আমার হৃদয়টা দেখতে পেতে --
নলিনী।
তা হলে ডুমুরের ফুল এবং সাপের পাঁচ পা'ও দেখতে পেতাম।
সতীশ।
আবার ঠাট্টা! তুমি বড়ো নিষ্ঠুর। সত্যই বলছি নেলি, আজ বিদায় নিতে এসেছি।
নলিনী।
দোকানে যেতে হবে?
সতীশ।
মিনতি করছি নেলি, ঠাট্টা করে আমাকে দগ্ধ কোরো না। আজ আমি চিরদিনের মতো বিদায় নেব।
নলিনী।
কেন,হঠাৎ সেজন্য তোমার এত বেশি আগ্রহ কেন।
সতীশ।
সত্য কথা বলি, আমি যে কত দরিদ্র তা তুমি জান না।
নলিনী।
সেজন্য তোমার ভয় কিসের। আমি তো তোমার কাছে টাকা ধার চাই নি।
সতীশ।
তোমার সঙ্গে আমার বিবাহের সম্বন্ধ হয়েছিল --
নলিনী।
তাই পালাবে? বিবাহ না হতেই হৃৎকম্প!
সতীশ।
আমার অবস্থা জানতে পেরে মিস্টার লাহিড়ি আমাদের সম্বন্ধ ভেঙে দিলেন।
নলিনী।
অমনি সেই অপমানেই কি নিরুদ্ধেশ হয়ে যেতে হবে। এতবড়ো অভিমানী লোকের কারো সঙ্গে কোনো সম্বন্ধ রাখা শোভা পায় না। সাধে আমি তোমার মুখে ভালোবাসার কথা শুনলেই ঠাট্টা করে উড়িয়ে দিই।
সতীশ।
নেলি, তবে কি এখনো আমাকে আশা রাখতে বল।
নলিনী।
দোহাই সতীশ, অমন নভেলি ছাঁদে কথা বানিয়ে বোলো না, আমার হাসি পায়। আমি তোমাকে আশা রাখতে বলব কেন। আশা যে রাখে সে নিজের গরজেই রাখে, লোকের পরামর্শ শুনে রাখে না।
সতীশ।
সে তো ঠিক কথা। আমি জানতে চাই, তুমি দারিদ্র৻কে ঘৃণা কর কি না।
নলিনী।
খুব করি, যদি সে-দারিদ্র৻ মিথ্যার দ্বারা নিজেকে ঢাকতে চেষ্টা করে।
সতীশ।
নেলি, তুমি কি কখনো তোমার চিরকালের অভ্যস্ত আরাম ছেড়ে গরিবের ঘরের লক্ষ্মী হতে পারবে।
নলিনী।
নভেলে যে-রকম ব্যারামের কথা পড়া যায় সেটা তেমন করে চেপে ধরলে আরাম আপনি ঘরছাড়া হয়।
সতীশ।
সে ব্যারামের কোনো লক্ষণ কি তোমার --
নলিনী।
সতীশ, তুমি কখনো কোনো পরীক্ষাতেই উত্তীর্ণ হতে পারলে না। স্বয়ং নন্দীসাহেবও বোধ হয় অমন প্রশ্ন তুলতেন না। তোমাদের এক চুলও প্রশয় দেওয়া চলে না।
সতীশ।
তোমাকে আমি আজও চিনতে পারলেম না নেলি।
নলিনী।
চিনবে কেমন করে। আমি তো তোমার হাল ফেশানের টাই নই --কলার কই -- দিনরাত যা নিয়ে ভাব তাই তুমি চেন।
সতীশ।
আমি হাত জোড় করে বলছি নেলি, তুমি আজ আমাকে এমন কথা বোলো না। আমি যে কী নিয়ে ভাবি তা তুমি নিশ্চয় জান।
নলিনী।
ঐ-যে, বাবা ডাকছেন। তাঁর কাজ হয়ে গেছে। যাই।
[ উভয়ের প্রস্থান
সুকুমারী ও শশধরের প্রবেশ
সুকুমারী।
দেখো, তোমাকে জানিয়ে রাখছি, আমার হরেনকে মারবার জন্যেই ওরা মায়ে-পোয়ে উঠে-পড়ে লেগেছে।
শশধর।
আঃ, কী বল। তুমি কি পাগল হয়েছ নাকি।
সুকুমারী।
আমি পাগল না তুমি চোখে দেখতে পাও না!
শশধর।
কোনোটাই আশ্চর্য নয়, দুটোই সম্ভব। কিন্তু --
সুকুমারী।
আমাদের হরেনের জন্ম হতেই দেখ নি ওদের মুখ কেমন হয়ে গেছে? সতীশের ভাবখানা দেখে বুঝতে পার না!
শশধর।
আমার অত ভাব বুঝবার ক্ষমতা নেই, সে তো তুমি জানই।
সুকুমারী।
সতীশ যখনই আড়ালে পায় তোমার ছেলেকে মারে, আবার বিধুও তার পিছনে পিছনে এসে খোকাকে জুজুর ভয় দেখায়।
শশধর।
ঐ দেখো, তোমরা ছোটো কথাকে বড়ো করে তোলো। যদিই বা সতীশ খোকাকে কখনো --
সুকুমারী।
সে তুমি সহ্য করতে পার, আমি পারব না -- ছেলেকে তো তোমার গর্ভে ধরতে হয় নি।
শশধর।
সে-কথা আমি অস্বীকার করতে পারব না। এখন তোমার অভিপ্রায় কী শুনি।
সুকুমারী।
শিক্ষা সম্বন্ধে তুমি তো বড়ো বড়ো কথা বল, একবার তুমি ভেবে দেখো-না, আমরা হরেনকে যে-ভাবে শিক্ষা দিতে চাই তার মাসি তাকে অন্যরূপ শেখায় -- সতীশের দৃষ্টান্তটিই বা তার পক্ষে কী রকম, সেটাও তো ভেবে দেখতে হয়।
শশধর।
তুমি যখন অত বেশি করে ভাবছ, তখন তার উপরে আমার আর ভাববার দরকার কী আছে। এখন কর্তব্য কী বলো।
সুকুমারী।
আমি বলি, সতীশকে তুমি বলো -- পুরুষমানুষ পরের পয়সায় বাবুগিরি করে, সে কি ভালো দেখতে হয়। আর, যার সামর্থ্য কম তার অত লম্বা চালেই বা দরকার কী।
শশধর।
মন্মথ সেই কথাই বলত। আমরাই তো সতীশকে অন্যরূপ বুঝিয়েছিলেম। এখন ওকে দোষ দিই কী করে।
সুকুমারী।
না -- দোষ কি ওর হতে পারে! সব দোষ আমারই। তুমি তো আর কারো কোনো দোষ দেখতে পাও না -- কেবল আমার বেলাতেই --
শশধর।
ওগো, রাগ কর কেন -- আমিও তো দোষী।
সুকুমারী।
তা হতে পারে। তোমার কথা তুমি জান। কিন্তু আমি কখনো ওকে এমন কথা বলি নি যে, তুমি তোমার মেসোর ঘরে পায়ের উপর পা দিয়ে গোঁফে তা দাও আর লম্বা কেদারায় বসে বসে আমার বাছার উপর বিষদৃষ্টি দিতে থাকো।
শশধর।
না, ঠিক ঐ কথাগুলো তুমি তাকে মাথার দিব্য দিয়ে শপথ করিয়ে নাও নি -- অতএব তোমাকে দোষ দিতে পারি নে। এখন কী করতে হবে বলো।
সুকুমারী।
সে তুমি যা ভালো বোঝ তাই করো। কিন্তু আমি বলছি, সতীশ যতক্ষণ এ-বাড়িতে থাকবে খোকাকে কোনোমতে বাইরে যেতে দিতে পারব না। ও তো আমারই আপন বোনের ছেলে। কিন্তু আমি ওকে এক মুহূর্তের জন্য বিশ্বাস করি নে -- এ আমি তোমাকে স্পষ্টই বললেম।
সতীশের প্রবেশ
সতীশ।
কাকে বিশ্বাস কর না, মাসিমা। আমাকে? আমি তোমার খোকাকে সুযোগ পেলে গলা টিপে মারব, এই তোমার ভয়? যদি মারি তবে তুমি তোমার বোনের ছেলের যে-অনিষ্ট করেছ, তার চেয়ে ওর কি বেশি অনিষ্ট করা হবে। কে আমাকে ছেলেবেলা হতে নবাবের মতো শৌখিন করে তুলেছে এবং আজ ভিক্ষুকের মতো পথে বের করলে। কে আমাকে পিতার শাসন থেকে বিশ্বের লাঞ্ছনার মধ্যে টেনে আনলে। কে আমাকে --
সুকুমারী।
ওগো, শুনছ? তোমার সামনে আমাকে এমনি করে অপমান করে? নিজের মুখে বললে কিনা খোকাকে গলা টিপে মারবে? ও মা, কী হবে গো। আমি কালসাপকে নিজের হাতে দুধকলা দিয়ে পুষেছি।
সতীশ।
দুধকলা আমারও ঘরে ছিল -- সে দুধকলায় আমার রক্ত বিষ হয়ে উঠত না -- তা থেকে চিরকালের মতো বঞ্চিত করে তুমি যে-দুধকলা আমাকে খাইয়েছ, তাতে আমার বিষ জমে উঠেছে। সত্যকথাই বলছ, এখন আমাকে ভয় করাই চাই -- এখন আমি দংশন করতে পারি।
বিধুমুখীর প্রবেশ
বিধুমুখী।
কী সতীশ, কী হয়েছে, তোকে দেখে যে ভয় হয়। অমন করে তাকিয়ে আছিস কেন। আমাকে চিনতে পারছিস্ নে? আমি তোর মা, সতীশ?
সতীশ।
মা, তোমাকে মা বলব কোন্ মুখে। মা হয়ে কেন তুমি আমাকে জেল থেকে ফিরিয়ে আনলে। সে কি মাসির ঘরের চেয়ে ভয়ানক।
শশধর।
আঃ সতীশ। চলো চলো -- কী বকছ, থামো।
সুকুমারী।
নাও, তোমরা বোঝাপড়া করো -- আমার কাজ আছে।
[প্রস্থান
শশধর।
সতীশ, একটু ঠাণ্ডা হও। তোমার প্রতি অত্যন্ত অন্যায় হয়েছে, সে কি আমি জানি নে। তোমার মাসি রাগের মুখে কী বলছেন, সে কি অমন করে মনে নিতে আছে। দেখো, গোড়ায় যা ভুল হয়েছে তা এখন যতটা সম্ভব প্রতিকার করা যাবে, তুমি নিশ্চিন্ত থাকো।
সতীশ।
মেসোমশায়, প্রতিকারের আর কোনো সম্ভাবনা নেই। মাসিমার সঙ্গে আমার এখন যেরূপ সম্পর্ক দাঁড়িয়েছে, তাতে তোমার ঘরের অন্ন আমার গলা দিয়ে আর গলবে না। এতদিন তোমাদের যা খরচ করিয়েছি তা যদি শেষ কড়িটি পর্যন্ত শোধ করে দিতে না পারি তবে আমার মরেও শান্তি নেই। প্রতিকার যদি কিছু থাকে তো সে আমার হাতে, তুমি কী প্রতিকার করবে।
শশধর।
না, শোনো সতীশ -- একটু স্থির হও। তোমার যা কর্তব্য সে তুমি পরে ভেবো; তোমার সম্বন্ধে আমরা যে-অন্যায় করেছি তার প্রায়শ্চিত্ত তো আমাকেই করতে হবে। দেখো, আমার বিষয়ের এক অংশ আমি তোমাকে লিখে দেব, সেটাকে তুমি দান মনে কোরো না, সে তোমার প্রাপ্য। আমি সমস্ত ঠিক করে রেখেছি -- পরশু শুক্রবারে রেজেস্ট্রি করে দেব।
সতীশ।
(শশধরের পায়ের ধুলা লইয়া) মেসোমশায়, কী আর বলব --তোমার এই স্নেহে --
শশধর।
আচ্ছা, থাক্ থাক্! ওসব স্নেহ-ফে্নহ আমি কিছু বুঝি নে, রস-কস আমার কিছুই নেই। যা কর্তব্য তা কোনোরকমে পালন করতেই হবে, এই বুঝি। সাড়ে-আটটা বাজল, তুমি আজ কোরিন্থিয়ানে যাবে বলেছিলে, যাও। -- সতীশ, একটা কথা তোমাকে বলে রাখি। দানপত্রখানা আমি মিস্টার লাহিড়িকে দিয়েই লিখিয়ে নিয়েছি। ভাবে বোধ হল, তিনি এই ব্যাপারে অত্যন্ত সন্তুষ্ট হলেন -- তোমার প্রতি যে টান নেই এমন তা দেখা গেল না। এমন-কি, আমি চলে আসবার সময় তিনি আমাকে বললেন, সতীশ আজকাল আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসে না কেন। আরো-একটা সুখবর আছে সতীশ, তোমাকে যে-আপিসে কাজ করিয়ে দিয়েছি সেখানকার বড়োসাহেব তোমার খুব সুখ্যাতি করছিলেন।
সতীশ।
সে আমার গুণে নয়। তোমাকে ভক্তি করেন বলেই আমাকে এত বিশ্বাস করেন।
[প্রস্থান
শশধর।
ওরে রামচরণ, তোর মাঠাকুরানীকে একবার ডেকে দে তো।
সুকুমারীর প্রবেশ
সুকুমারী।
কী স্থির করলে।
শশধর।
একটা চমৎকার প্ল্যান ঠাউরেছি।
সুকুমারী।
তোমার প্ল্যান যত চমৎকার হবে সে আমি জানি। যা হোক, সতীশকে এ বাড়ি থেকে বিদায় করেছ তো।
শশধর।
তাই যদি না করব, তবে আর প্ল্যান কিসের। আমি ঠিক করেছি,সতীশকে আমাদের তরফ মানিকপুর লিখে-পড়ে দেব -- তা হলেই সে স্বচ্ছন্দে নিজের খরচ চালিয়ে আলাদা হয়ে থাকতে পারবে। তোমাকে আর বিরক্ত করবে না।
সুকুমারী।
আহা, কী সুন্দর প্ল্যানই ঠাউরেছ। সৌন্দর্যে আমি একেবারে মুগ্ধ! না না, তুমি অমন পাগলামি করতে পারবে না। আমি বলে দিলাম।
শশধর।
দেখো, এক সময়ে তো ওকেই সমস্ত সম্পত্তি দেবার কথা ছিল। সুকুমারী। তখন তো আমার হরেন জন্মায় নি। তা ছাড়া তুমি কি ভাব, তোমার আর ছেলেপুলে হবে না?
শশধর।
সুকু, ভেবে দেখো, আমাদের অন্যায় হচ্ছে। মনেই করো-না কেন তোমার দুই ছেলে।
সুকুমারী।
সে আমি অতশত বুঝি নে -- তুমি যদি এমন কাজ কর তবে আমি গলায় দড়ি দিয়ে মরব -- এই আমি বলে গেলেম।
[প্রস্থান
সতীশের প্রবেশ
শশধর।
কী সতীশ, থিয়েটারে গেলে না?
সতীশ।
না মেসোমশায়, আর থিয়েটার না। এই দেখো, দীর্ঘকাল পরে মিস্টার লাহিড়ির কাছ থেকে নিমন্ত্রণ পেয়েছি। তোমার দানপত্রের ফল দেখো। সংসারের উপর আমার ধিক্কার জন্মে গেছে, মেসোমশায়। আমি তোমার সে তালুক নেব না।
শশধর।
কেন সতীশ।
সতীশ।
নিজের কোনো মূল্য থাকে তবে সেই মূল্য দিয়ে যতটুকু পাওয়া যায় ততটুকুই ভোগ করব। তা ছাড়া তুমি যে আমাকে তোমার সম্পত্তির অংশ দিতে চাও, মাসিমার সম্মতি নিয়েছ তো?
শশধর।
না, সে তিনি -- অর্থাৎ, বুঝেছ -- সে এক রকম করে হবে। হঠাৎ তিনি রাজি না হতে পারেন, কিন্তু -- যদিই বা --
সতীশ।
তুমি তাঁকে বলেছ?
শশধর।
হাঁ, বলেছি বৈকি। বিলক্ষণ! তাঁকে না বলেই কি আর --
সতীশ।
তিনি রাজি হয়েছেন?
শশধর।
তাকে ঠিক রাজি বলা যায় না বটে, কিন্তু ভালো করে বুঝিয়ে-ধৈর্য ধরে থাকলেই --
সতীশ।
বৃথা চেষ্টা, মেসোমশায়। তাঁর নারাজিতে তোমার সম্পত্তি আমি নিতে চাই নে। তুমি তাঁকে বোলো, আজ পর্যন্ত তিনি যে অন্ন খাইয়েছেন তা উদগার না করে আমি বাঁচব না। তাঁর সমস্ত ঋণ সুদসুদ্ধ শোধ করে তবে আমি হাঁফ ছাড়ব।
শশধর।
সে কিছুই দরকার নেই, সতীশ। তোমাকে বরঞ্চ কিছু নগদ টাকা গোপনে --
সতীশ।
না মেসোমশায়, আর ঋণ বাড়াব না। মাসিমাকে বোলো, আজই এখনই তাঁর কাছে হিসাব চুকিয়ে তবে জলগ্রহণ করব।
[প্রস্থান
পঞ্চম দৃশ্য
বাগান
সুকুমারীর প্রবেশ
সুকুমারী।
দেখো দেখি, এখন সতীশ কেমন পরিশ্রম করে কাজকর্ম করছে। দেখো, অতবড়ো সাহেব-বাবু আজকাল পুরোনো কালো আলপাকার চাপকানের উপরে কোঁচানো চাদর ঝুলিয়ে কেমন নিয়মিত আপিসে যায়!
শশধর।
বড়োসাহেব সতীশের খুব প্রশংসা করেন।
সুকুমারী।
ভালোই তো, যা মাইনে পাবে তাতেই বেশ চলে যাবে। তার উপরে যদি তোমার জমিদারিটা তাকে দিয়ে বস, তবে একদিনে সে টাই-কলার-জুতা-ছড়ি কিনেই সেটা নিলামে চড়িয়ে দেবে। আমার পরামর্শ নিয়ে যদি চলতে তবে সতীশ এতদিনে মানুষের মতো হত।
শশধর।
বিধাতা আমাদের বুদ্ধি দেন নি, কিন্তু স্ত্রী দিয়েছেন; আর তোমাদের বুদ্ধি দিয়েছেন, তেমনি সঙ্গে সঙ্গে নির্বোধ স্বামীগুলাকেও তোমাদের হাতে সমর্পণ করেছেন -- আমাদেরই জিত।
সুকুমারী।
আচ্ছা, আচ্ছা, ঢের হয়েছে, ঠাট্টা করতে হবে না। কিন্তু সতীশের পিছনে এতদিন যে-টাকাটা ঢেলেছ সে যদি আজ থাকত, তবে --
শশধর।
সতীশ তো বলেছে, কোনো-একদিন সে সমস্তই শোধ করে দেবে।
সুকুমারী।
রইল। সে তো বরাবরই ঐরকম লম্বাচৌড়া কথা বলে থাকে। তুমি বুঝি সেই ভরসায় পথ চেয়ে বসে আছ।
শশধর।
এতদিন তো ভরসা ছিল, তুমি যদি পরামর্শ দাও তো সেটা বিসর্জন দিই।
সুকুমারী।
দিলে তোমার বেশি লোকসান হবে না, এই পর্যন্ত বলতে পারি। ঐ-যে তোমার সতীশবাবু আসছেন। আমি যাই।
সতীশের প্রবেশ
সতীশ।
মাসিমা, পালাতে হবে না, এই দেখো, আমার হাতে অস্ত্রশস্ত্র কিছুই নেই -- কেবল খানকয়েক নোট আছে।
শশধর।
ইস্, এ যে একতাড়া নোট। যদি আপিসের টাকা হয় তো এমন করে সঙ্গে নিয়ে বেড়ানো ভালো হচ্ছে না, সতীশ।
সতীশ।
আর সঙ্গে নিয়ে বেড়াব না। মাসিমার পায়ে বিসর্জন দিলাম। প্রণাম হই মাসিমা। বিস্তর অনুগ্রহ করেছিলে, তখন তার হিসাব রাখতে হবে মনেও করি নি, সুতরাং পরিশোধের অঙ্কে কিছু ভুলচুক হতে পারে। এই পনরোহাজার টাকা গুনে নাও। তোমার হরেনের পোলাও-পরামান্নে একটি তণ্ডুলকণাও কম না পড়ুক।
শশধর।
এ কী কাণ্ড, সতীশ! এত টাকা কোথায় পেলে।
সতীশ।
আমি গুনচট আজ ছয়মাস আগাম খরিদ করে রেখেছি -- ইতিমধ্যে দর চড়েছে; তাই মুনাফা পেয়েছি।
শশধর।
সতীশ, এ-যে জুয়োখেলা।
সতীশ।
খেলা এইখানেই শেষ, আর দরকার হবে না।
শশধর।
তোমার এ-টাকা তুমি নিয়ে যাও, আমি চাই না।
সতীশ।
তোমাকে তো দিই নি, মেসোমশায়। এ মাসিমার ঋণশোধ, তোমার ঋণ কোনোকালে শোধ করতে পারব না।
শশধর।
কী সুকু, এ টাকাগুলো --
সুকুমারী।
গুনে খাতাঞ্জির হাতে দাও-না, ঐখানেই কি ছড়ানো পড়ে থাকবে।
[ নোটগুলি তুলিয়া গুনিয়া দেখা
শশধর।
সতীশ, খেয়ে এসেছ তো?
সতীশ।
বাড়ি গিয়ে খাব।
শশধর।
অ্যাঁ, সে কী কথা। বেলা-যে বিস্তর হয়েছে। আজ এইখানেই খেয়ে যাও।
সতীশ।
আর খাওয়া নয়, মেসোমশায়। এক দফা শোধ করলেম, অন্নঋণ আর নূতন করে ফাঁদতে পারব না।
[প্রস্থান
সুকুমারী।
বাপের হাত থেকে রক্ষা করে এতদিন ওকে খাইয়ে পরিয়ে মানুষ করলেম, আজ হাতে দুপয়সা আসতেই ভাবখানা দেখেছ? কৃতজ্ঞতা এমনই বটে! ঘোর কলি কিনা!
[ উভয়ের প্রস্থান
সতীশের প্রবেশ
সতীশ।
এই পিস্তলে দুটি গুলি পুরেছি -- এই যথেষ্ট। আমার অন্তিমের প্রেয়সী। ও কে ও? হরেন! কী করছিস? এই সন্ধ্যার সময় বাগানে অন্ধকার যে, চারি দিকে কেউ নেই -- পালা, পালা, পালা। (কপালে আঘাত করিয়া) সতীশ, কী ভাবছিস তুই -- ওরে সর্বনেশে, চুপ চুপ -- না না না, এ কি বকছি। আমি কি পাগল হয়ে গেলুম -- কে আছিস ওখানে। বেহারা, বেহারা! কেউ না, কেউ কোত্থাও নেই। মাসিমা! শুনতে পাচ্ছ? ইঃ, একেবারে লুটোপুটি করতে থাকবে। আঃ। হাতকে আর সামলাতে পারছি নে। হাতটাকে নিয়ে কী করি। হাতটাকে নিয়ে কী করা যায়।
[ ছড়ি লইয়া সতীশ সবেগে চারাগাছগুলিকে ক্রমাগত আঘাত করিতে লাগিল। তাহাতে তাহার উত্তেজনা ক্রমশ আরো বাড়িয়া উঠিতে লাগিল। অবশেষে নিজের হাতকে সবেগে আঘাত করিল, কিন্তু কোনো বেদনা বোধ করিল না, শেষে পকেটের ভিতর হইতে পিস্তল সংগ্রহ করিয়া লইয়া সে হরেনের দিকে সবেগে অগ্রসর হইতে লাগিল। ]
হরেন।
(চমকিয়া উঠিয়া) এ কী! দাদা নাকি। তোমার দুটি পায়ে পড়ি দাদা, তোমার দুটি পায়ে পড়ি, কাঁচা পেয়ারা পাড়ছিলুম, বাবাকে বলে দিয়ো না।
সতীশ।
(চীৎকার করিয়া) মেসোমশায়, মেসোমশায়, এই বেলা রক্ষা করো, আর দেরি কোরো না -- তোমার ছেলেকে এখনো রক্ষা করো।
শশধর।
(ছুটিয়া আসিয়া) কী হয়েছে, সতীশ। কী হয়েছে।
সুকুমারী।
(ছুটিয়া আসিয়া) কী হয়েছে, সতীশ। কী হয়েছে।
হরেন।
কিছুই হয় নি, মা -- কিছুই না -- দাদা তোমাদের সঙ্গে ঠাট্টা করছেন।
সুকুমারী।
এ কী রকম বিশ্রী ঠাট্টা। ছি ছি, সকলই অনাসৃষ্টি। দেখো দেখি! আমার বুক এখনো ধড়াস-ধড়াস করছে। সতীশ, মদ ধরেছে বুঝি।
সতীশ।
পালাও -- তোমার ছেলেকে নিয়ে এখনই পালাও! নইলে তোমাদের রক্ষা নেই।
[ হরেনকে লইয়া ত্রস্তপদে সুকুমারীর পলায়ন
শশধর।
সতীশ, অমন উতলা হোয়ো না। ব্যাপারটা কী বলো। হরেনকে কার হাত থেকে রক্ষা করবার জন্য ডেকেছিলে।
সতীশ।
আমার হাত থেকে। (পিস্তল দেখাইয়া) এই দেখো, এই দেখো, মেসোমশায়।
দ্রুতপদে বিধুমুখীর প্রবেশ
বিধুমুখী।
সতীশ, তুই কোথায় কী সর্বনাশ করে এসেছিস বল্ দেখি! আপিসের সাহেব পুলিস সঙ্গে নিয়ে আমাদের বাড়িতে খানাতল্লাসি করতে এসেছে। যদি পালাতে হয়, এই বেলা পালা। হায় ভগবান, আমি তো কোনো পাপ করি নি, আমারই অদৃষ্টে এত দুঃখ ঘটে কেন।
সতীশ।
ভয় নেই -- পালাবার উপায় আমার হাতেই আছে।
শশধর।
তবে কি তুমি --
সতীশ।
তাই বটে মেসোমশায়, যা সন্দেহ করছ তাই। আমি চুরি করে মাসির ঋণ শোধ করেছি। আমি চোর। মা, তুমি শুনে খুশি হবে, আমি চোর, আমি খুনী! তোমার কীর্তি পুরো হল। এখন আর কাঁদতে হবে না-- যাও তুমি, যাও তুমি, যাও যাও, আমার সম্মুখ থেকে যাও। আমার অসহ্য বোধ হচ্ছে।
শশধর।
সতীশ, তুমি আমার কাছেও তো কিছু ঋণী আছ, তাই শোধ করে যাও।
সতীশ।
বলো কেমন করে শোধ করব। কী আমি দিতে পারি। কী চাও তুমি।
শশধর।
ঐ পিস্তলটা।
সতীশ।
এই দিলাম। আমি জেলেই যাব। না গেলে আমার পাপের ঋণ শোধ হবে না।
শশধর।
পাপের ঋণ শাস্তির দ্বারা শোধ হয় না সতীশ, কর্মের দ্বারাই শোধ হয়। তুমি নিশ্চয় জেনো, আমি অনুরোধ করলে তোমার বড়োসাহেব তোমাকে জেলে দেবেন না। এখন থেকে জীবনকে সার্থক করে বেঁচে থাকো।
সতীশ।
মেসোমশায়, আমার পক্ষে বাঁচা যে কত কঠিন তা তুমি জানো না--
শশধর।
তবু বাঁচতে হবে, আমার ঋণের এই শোধ। আমাকে ফাঁকি দিয়ে পালাতে পারবে না।
সতীশ।
তবে তাই হবে।
শশধর।
আমার একটা অনুরোধ শোনো। তোমার মাকে আর মাসীকে ক্ষমা করো।
বিধুমুখী।
বাবা, আমার কপালে ক্ষমা না থাকে নাই থাক্, ভগবান তোকে যেন ক্ষমা করেন। দিদির কাছে যাই। তাঁর পায়ে ধরি গে।
[প্রস্থান
শশধর।
তবে এসো সতীশ, আমার ঘরে আজ আহার করে যেতে হবে।
দ্রুতপদে নলিনীর প্রবেশ
নলিনী।
সতীশ!
সতীশ।
কী নলিনী।
নলিনী।
এর মানে কী? এ চিঠি তুমি আমাকে কেন লিখেছ।
সতীশ।
মানে যেমন বুঝেছিলে সেইটেই ঠিক। আমি তোমাকে প্রতারণা করে চিঠি লিখি নি। তবে আমার ভাগ্যক্রমে সকলই উলটো হয়। তুমি মনে করতে পার, তোমার দয়া উদ্রেক করবার জন্যই আমি -- কিন্তু মেসোমশায় সাক্ষী আছেন, আমি অভিনয় করছিলেম না -- তবু যদি বিশ্বাস না হয় প্রতিজ্ঞা রক্ষা করবার এখনো সময় আছে!
নলিনী।
কী তুমি পাগলের মতো বকছ। আমি তোমার কী অপরাধ করেছি যে তুমি আমাকে এমন নিষ্ঠুরভাবে --
সতীশ।
যেজন্য আমি এই সংকল্প করেছি সে তুমি জান, নলিনী -- আমি তো একবর্ণও গোপন করি নি, তবু কি আমার উপর শ্রদ্ধা আছে।
নলিনী।
শ্রদ্ধা! সতীশ, তোমার উপর ঐজন্যই আমার রাগ ধরে। শ্রদ্ধা -- ছি ছি, শ্রদ্ধা তো পৃথিবীতে অনেকেই অনেককে করে। তুমি যে-কাজ করেছ আমিও তাই করেছি -- তোমাতে আমাতে কোনো ভেদ রাখি নি। এই দেখো, আমার গহনাগুলি সব এনেছি -- এগুলো এখনো আমার সম্পত্তি নয় -- এগুলি আমার বাপ-মায়ের। আমি তাঁদের না ব'লে চুরি করেই এনেছি, এর কত দাম হত পারে আমি কিছুই জানি নে; কিন্তু এ দিয়ে কি তোমার উদ্ধার হবে না।
শশধর।
উদ্ধার হবে; এই গহনাগুলির সঙ্গে আরো অমূল্য যে-ধনটি দিয়েছ তা দিয়েই সতীশের উদ্ধার হবে।
নলিনী।
এই যে শশধরবাবু, মাপ করবেন, তাড়াতাড়িতে আপনাকে আমি--
শশধর।
মা, সেজন্য লজ্জা কী। দৃষ্টির দোষ কেবল আমাদের মতো বুড়োদেরই হয় না -- তোমাদের বয়সে আমাদের মতো প্রবীণ লোক হঠাৎ চোখে ঠেকে না। -- সতীশ, তোমার আপিসের সাহেব এসেছেন দেখছি। আমি তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা কয়ে আসি। ততক্ষণ তুমি আমার হয়ে অতিথিসৎকার করো। মা, এই পিস্তলটা এখন তোমার জিম্মাতেই থাকতে পারে।