কৈশোরিকা (koishorika)
হে কৈশোরের প্রিয়া,
ভোরবেলাকার আলোক-আঁধার-লাগা
চলেছিলে তুমি আধ্ঘুমো-আধ্জাগা
মোর জীবনের ঘন বনপথ দিয়া।
ছায়ায় ছায়ায় আমি ফিরিতাম একা,
দেখি দেখি করি শুধু হয়েছিল দেখা
চকিত পায়ের চলার ইশারাখানি।
চুলের গন্ধে ফুলের গন্ধে মিলে
পিছে পিছে তব বাতাসে চিহ্ন দিলে
বাসনার রেখা টানি।
প্রভাত উঠিল ফুটি।
অরুণরাঙিমা দিগন্তে গেল ঘুচে,
শিশিরের কণা কুঁড়ি হতে গেল মুছে,
গাহিল কুঞ্জে কপোতকপোতী দুটি।
ছায়াবীথি হতে বাহিরে আসিলে ধীরে
ভরা জোয়ারের উচ্ছল নদীতীরে--
প্রাণকল্লোলে মুখর পল্লিবাটে।
আমি কহিলাম, "তোমাতে আমাতে চলো,
তরুণ রৌদ্র জলে করে ঝলোমলো--
নৌকা রয়েছে ঘাটে।"
স্রোতে চলে তরী ভাসি।
জীবনের-স্মৃতি-সঞ্চয়-করা তরী
দিনরজনীর সুখে দুখে গেছে ভরি,
আছে গানে-গাঁথা কত কান্না ও হাসি।
পেলব প্রাণের প্রথম পসরা নিয়ে
সে তরণী-'পরে পা ফেলেছ তুমি প্রিয়ে,
পাশাপাশি সেথা খেয়েছি ঢেউয়ের দোলা।
কখনো বা কথা কয়েছিলে কানে কানে,
কখনো বা মুখে ছলোছলো দুনয়ানে
চেয়েছিলে ভাষা-ভোলা।
বাতাস লাগিল পালে।
ভাঁটার বেলায় তরী যবে যায় থেমে
অচেনা পুলিনে কবে গিয়েছিলে নেমে
মলিন ছায়ার ধূসর গোধূলিকালে।
আবার রচিলে নব কুহকের পালা,
সাজালে ডালিতে নূতন বরণমালা,
নয়নে আনিলে নূতন চেনার হাসি।
কোন্ সাগরের অধীর জোয়ার লেগে
আবার নদীর নাড়ী নেচে ওঠে বেগে,
আবার চলিনু ভাসি।
তুমি ভেসে চল সাথে।
চিররূপখানি নবরূপে আসে প্রাণে;
নানা পরশের মাধুরীর মাঝখানে
তোমারই সে হাত মিলেছে আমার হাতে।
গোপন গভীর রহস্যে অবিরত
ঋতুতে ঋতুতে সুরের ফসল যত
ফলায়ে তুলেছে বিস্মিত মোর গীতে।
শুকতারা তব কয়েছিল যে কথারে
সন্ধ্যার আলো সোনার গলায় তারে
সকরুণ পূরবীতে।
চিনি, নাহি চিনি তবু।
প্রতি দিবসের সংসারমাঝে তুমি
স্পর্শ করিয়া আছ যে-মর্তভূমি
তার আবরণ খসে পড়ে যদি কভু,
তখন তোমার মূরতি দীপ্তিমতী
প্রকাশ করিবে আপন অমরাবতী
সকল কাজের বিরহের মহাকাশে।
তাহারই বেদনা কত কীর্তির স্তূপে
উচ্ছ্রিত হয়ে ওঠে অসংখ্য রূপে
পুরুষের ইতিহাসে।
হে কৈশোরের প্রিয়া,
এ জনমে তুমি নব জীবনের দ্বারে
কোন্ পার হতে এনে দিলে মোর পায়ে
অনাদি যুগের চিরমানবীর হিয়া।
দেশের কালের অতীত যে মহাদূর,
তোমার কণ্ঠে শুনেছি তাহারই সুর--
বাক্য সেথায় নত হয় পরাভবে।
অসীমের দূতী, ভরে এনেছিলে ডালা
পরাতে আমারে নন্দনফুলমালা
অপূর্ব গৌরবে।