বহুদিন পরে আজি মেঘ গেছে চলে, রবির কিরণসুধা আকাশে উথলে। স্নিগ্ধ শ্যাম পত্রপুটে আলোক ঝলকি উঠে পুলক নাচিছে গাছে গাছে। নবীন যৌবন যেন প্রেমের মিলনে কাঁপে, আনন্দ বিদ্যুৎ-আলো নাচে। জুঁই সরোবরতীরে নিশ্বাস ফেলিয়া ধীরে ঝরিয়া পড়িতে চায় ভুঁয়ে, অতি মৃদু হাসি তার, বরষার বৃষ্টিধার গন্ধটুকু নিয়ে গেছে ধুয়ে। আজিকে আপন প্রাণে না জানি বা কোন্খানে যোগিয়া রাগিণী গায় কে রে। ধীরে ধীরে সুর তার মিলাইছে চারি ধার, আচ্ছন্ন করিছে প্রভাতেরে। গাছপালা চারি ভিতে সংগীতের মাধুরীতে মগ্ন হয়ে ধরে স্বপ্নছবি। এ প্রভাত মনে হয় আরেক প্রভাতময়, রবি যেন আর কোনো রবি। ভাবিতেছি মনে মনে কোথা কোন্ উপবনে কী ভাবে সে গান গাইছে না জানি, চোখে তার অশ্রুরেখা একটু দেছে কি দেখা, ছড়ায়েছে চরণ দুখানি। তার কি পায়ের কাছে বাঁশিটি পড়িয়া আছে-- আলোছায়া পড়েছে কপোলে। মলিন মালাটি তুলি ছিঁড়ি ছিঁড়ি পাতাগুলি ভাসাইছে সরসীর জলে। বিষাদ-কাহিনী তার সাধ যায় শুনিবার কোন্খানে তাহার ভবন। তাহার আঁখির কাছে যার মুখ জেগে আছে তাহারে বা দেখিতে কেমন। এ কী রে আকুল ভাষা! প্রাণের নিরাশ আশা পল্লবের মর্মরে মিশালো। না জানি কাহারে চায় তার দেখা নাহি পায় ম্লান তাই প্রভাতের আলো। এমন কত-না প্রাতে চাহিয়া আকাশপাতে কত লোক ফেলেছে নিশ্বাস, সে-সব প্রভাত গেছে, তারা তার সাথে গেছে লয়ে গেছে হৃদয়-হুতাশ! এমন কত না আশা কত ম্লান ভালোবাসা প্রতিদিন পড়িছে ঝরিয়া, তাদের হৃদয়-ব্যথা তাদের মরণ-গাথা কে গাইছে একত্র করিয়া, পরস্পর পরস্পরে ডাকিতেছে নাম ধরে, কেহ তাহা শুনিতে না পায়। কাছে আসে, বসে পাশে,তবুও কথা না ভাষে, অশ্রুজলে ফিরে ফিরে যায়। চায় তবু নাহি পায়, অবশেষে নাহি চায়, অবশেষে নাহি গায় গান, ধীরে ধীরে শূন্য হিয়া বনের ছায়ায় গিয়া মুছে আসে সজল নয়ান।
সকলে আমার কাছে যত কিছু চায় সকলেরে আমি তাহা পেরেছি কি দিতে! আমি কি দিই নি ফাঁকি কত জনে হায়, রেখেছি কত-না ঋণ এই পৃথিবীতে। আমি তবে কেন বকি সহস্র প্রলাপ, সকলের কাছে চাই ভিক্ষা কুড়াইতে! এক তিল না পাইলে দিই অভিশাপ, অমনি কেন রে বসি কাতরে কাঁদিতে! হা ঈশ্বর, আমি কিছু চাহি নাকো আর, ঘুচাও আমার এই ভিক্ষার বাসনা। মাথায় বহিয়া লয়ে চির ঋণভার "পাইনি' "পাইনি' বলে আর কাঁদিব না। তোমারেও মাগিব না, অলস কাঁদনি-- আপনারে দিলে তুমি আসিবে আপনি।