আমার কাছে রাজা আমার রইল অজানা। তাই সে যখন তলব করে খাজানা মনে করি পালিয়ে গিয়ে দেব তারে ফাঁকি, রাখব দেনা বাকি। যেখানেতেই পালাই আমি গোপনে দিনে কাজের আড়ালেতে, রাতে স্বপনে, তলব তারি আসে নিশ্বাসে নিশ্বাসে। তাই জেনেছি, আমি তাহার নইকো অজানা। তাই জেনেছি ঋণের দায়ে ডাইনে বাঁয়ে বিকিয়ে বাসা নাইকো আমার ঠিকানা। তাই ভেবেছি জীবন-মরণে যা আছে সব চুকিয়ে দেব চরণে। তাহার পরে নিজের জোরে নিজেরি স্বত্বে মিলবে আমার আপন বাসা তাঁহার রাজত্বে।
সাগরতীরে পাথরপিণ্ড ঢুঁ মারতে চায় কাকে, বুঝি আকাশটাকে। শান্ত আকাশ দেয় না কোনো জবাব, পাথরটা রয় উঁচিয়ে মাথা, এমনি সে তার স্বভাব। হাতের কাছেই আছে সমুদ্রটা, অহংকারে তারই সঙ্গে লাগত যদি ওটা, এমনি চাপড় খেত, তাহার ফলে হুড়্মুড়িয়ে ভেঙেচুরে পড়ত অগাধ জলে। ঢুঁ-মারা এই ভঙ্গীখানা কোটি বছর থেকে ব্যঙ্গ ক'রে কপালে তার কে দিল ঐ এঁকে। পণ্ডিতেরা তার ইতিহাস বের করেছেন খুঁজি; শুনি তাহা, কতক বুঝি, নাইবা কতক বুঝি। অনেক যুগের আগে একটা সে কোন্ পাগলা বাষ্প আগুন-ভরা রাগে মা ধরণীর বক্ষ হতে ছিনিয়ে বাঁধন-পাশ জ্যোতিষ্কদের ঊর্ধ্বপাড়ায় করতে গেল বাস। বিদ্রোহী সেই দুরাশা তার প্রবল শাসন-টানে আছাড় খেয়ে পড়ল ধরার পানে। লাগল কাহার শাপ, হারালো তার ছুটোছুটি, হারালো তার তাপ। দিনে দিনে কঠিন হয়ে ক্রমে আড়ষ্ট এক পাথর হয়ে কখন গেল জমে। আজকে যে ওর অন্ধ নয়ন, কাতর হয়ে চায় সম্মুখে কোন্ নিঠুর শূন্যতায়। স্তম্ভিত চীৎকার সে যেন, যন্ত্রণা নির্বাক, যে যুগ গেছে তার উদ্দেশে কণ্ঠহারার ডাক। আগুন ছিল পাখায় যাহার আজ মাটি-পিঞ্জরে কান পেতে সে আছে ঢেউয়ের তরল কলস্বরে; শোনার লাগি ব্যগ্র তাহার ব্যর্থ বধিরতা হেরে-যাওয়া সে-যৌবনের ভুলে-যাওয়া কথা।
আজ শরতের আলোয় এই যে চেয়ে দেখি মনে হয় এ যেন আমার প্রথম দেখা। আমি দেখলেম নবীনকে, প্রতিদিনের ক্লান্ত চোখ যার দর্শন হারিয়েছে। কল্পনা করছি,-- অনাগত যুগ থেকে তীর্থযাত্রী আমি ভেসে এসেছি মন্ত্রবলে। উজান স্বপ্নের স্রোতে পৌঁছলেম এই মুহূর্তেই বর্তমান শতাব্দীর ঘাটে। কেবলি তাকিয়ে আছি উৎসুক চোখে। আপনাকে দেখছি আপনার বাইরে,-- অন্যযুগের অজানা আমি অভ্যস্ত পরিচয়ের পরপারে। তাই তাকে নিয়ে এত গভীর কৌতূহল। যার দিকে তাকাই চক্ষু তাকে আঁকড়িয়ে থাকে পুষ্পলগ্ন ভ্রমরের মতো। আমার নগ্নচিত্ত আজ মগ্ন হয়েছে সমস্তের মাঝে। জনশ্রুতির মলিন হাতের দাগ লেগে যার রূপ হয়েছে অবলুপ্ত, যা পরেছে তুচ্ছতার মলিন চীর তার সে জীর্ণ উত্তরীয় আজ গেল খ'সে। দেখা দিল সে অস্তিত্বের পূর্ণ মূল্যে। দেখা দিল সে অনির্বচনীয়তায়। যে বোবা আজ পর্যন্ত ভাষা পায়নি জগতের সেই অতি প্রকাণ্ড উপেক্ষিত আমার সামনে খুলেছে তার অচল মৌন, ভোর-হয়ে-ওঠা বিপুল রাত্রির প্রান্তে প্রথম চঞ্চল বাণী জাগল যেন। আমার এতকালের কাছের জগতে আমি ভ্রমণ করতে বেরিয়েছি দূরের পথিক। তার আধুনিকের ছিন্নতার ফাঁকে ফাঁকে দেখা দিয়েছে চিরকালের রহস্য। সহমরণের বধূ বুঝি এমনি ক'রেই দেখতে পায় মৃত্যুর ছিন্নপর্দার ভিতর দিয়ে নূতন চোখে চিরজীবনের অম্লান স্বরূপ।