আমি এ কেবল মিছে বলি, শুধু আপনার মন ছলি। কঠিন বচন শুনায়ে তোমারে আপন মর্মে জ্বলি। থাক্ তবে থাক্ ক্ষীণ প্রতারণা, কী হবে লুকায়ে বাসনা বেদনা, যেমন আমার হৃদয়-পরান তেমনি দেখাব খুলি। আমি মনে করি যাই দূরে, তুমি রয়েছ বিশ্ব জুড়ে। যত দূরে যাই ততই তোমার কাছাকাছি ফিরি ঘুরে। চোখে চোখে থেকে কাছে নহ তবু, দূরেতে থেকেও দূর নহ কভু, সৃষ্টি ব্যাপিয়া রয়েছ তবুও আপন অন্তঃপুরে। আমি যেমনি করিয়া চাই, আমি যেমনি করিয়া গাই, বেদনাবিহীন ওই হাসিমুখ সমান দেখিতে পাই। ওই রূপরাশি আপনা বিকাশি রয়েছে পূর্ণ গৌরবে ভাসি, আমার ভিখারি প্রাণের বাসনা হোথায় না পায় ঠাঁই। শুধু ফুটন্ত ফুল-মাঝে দেবী, তোমার চরণ সাজে। অভাবকঠিন মলিন মর্ত্য কোমল চরণে বাজে। জেনে শুনে তবু কী ভ্রমে ভুলিয়া আপনারে আমি এনেছি তুলিয়া, বাহিরে আসিয়া দরিদ্র আশা লুকাতে চাহিছে লাজে। তবু থাক্ পড়ে ওইখানে, চেয়ে তোমার চরণ-পানে। যা দিয়েছি তাহা গেছে চিরকাল আর ফিরিবে না প্রাণে। তবে ভালো করে দেখো একবার দীনতা হীনতা যা আছে আমার, ছিন্ন মলিন অনাবৃত হিয়া অভিমান নাহি জানে। তবে লুকাব না আমি আর এই ব্যথিত হৃদয়ভার। আপনার হাতে চাব না রাখিতে আপনার অধিকার। বাঁচিলাম প্রাণে তেয়াগিয়া লাজ, বদ্ধ বেদনা ছাড়া পেল আজ, আশা-নিরাশায় তোমারি যে আমি জানাইনু শত বার।
এই করেছ ভালো, নিঠুর, এই করেছ ভালো। এমনি করে হৃদয়ে মোর তীব্র দহন জ্বালো। আমার এ ধূপ না পোড়ালে গন্ধ কিছুই নাহি ঢালে, আমার এ দীপ না জ্বালালে দেয় না কিছুই আলো। যখন থাকে অচেতনে এ চিত্ত আমার আঘাত সে যে পরশ তব সেই তো পুরস্কার। অন্ধকারে মোহে লাজে চোখে তোমায় দেখি না যে, বজ্রে তোলো আগুন করে আমার যত কালো।
সেই তো আমি চাই। সাধনা যে শেষ হবে মোর সে ভাবনা তো নাই। ফলের তরে নয় তো খোঁজা-- কে বইবে সে বিষম বোঝা, যেই ফলে ফল ধুলায় ফেলে আবার ফুল ফুটাই। এমনি করে মোর জীবনে অসীম ব্যাকুলতা, নিত্য নূতন সাধনাতে নিত্য নূতন ব্যথা। পেলেই সে তো ফুরিয়ে ফেলি, আবার আমি দু হাত মেলি-- নিত্য দেওয়া ফুরায় না যে নিত্য নেওয়া তাই।