এ কথা সে কথা মনে আসে, বর্ষাশেষে শরতের মেঘ যেন ফিরিছে বাতাসে। কাজের বাঁধনহারা শূন্যে করে মিছে আনাগোনা; কখনো রুপালি আঁকে, কখনো ফুটায়ে তোলে সোনা। অদ্ভুত মূর্তি সে রচে দিগন্তের কোণে, রেখার বদল করে পুনঃ পুনঃ যেন অন্যমনে। বাষ্পের সে শিল্পকাজ যেন আনন্দের অবহেলা-- কোনোখানে দায় নেই, তাই তার অর্থহীন খেলা। জাগার দায়িত্ব আছে, কাজ নিয়ে তাই ওঠাপড়া। ঘুমের তো দায় নেই, এলোমেলো স্বপ্ন তাই গড়া। মনের স্বপ্নের ধাত চাপা থাকে কাজের শাসনে, বসিতে পায় না ছুটি স্বরাজ-আসনে। যেমনি সে পায় ছাড়া খেয়ালে খেয়ালে করে ভিড়, স্বপ্ন দিয়ে রচে যেন উড়ুক্ষু পাখির কোন্ নীড়। আপনার মাঝে তাই পেতেছি প্রমাণ-- স্বপ্নের এ পাগলামি বিশ্বের আদিম উপাদান। তাহারে দমনে রাখে, ধ্রুব করে সৃষ্টির প্রণালী কর্তৃত্ব প্রচণ্ড বলশালী। শিল্পের নৈপুণ্য এই উদ্দামেরে শৃঙ্খলিত করা, অধরাকে ধরা।
ধর্মের বেশে মোহ যারে এসে ধরে অন্ধ সে জন মারে আর শুধু মরে। নাস্তিক সেও পায়ে বিধাতার বর, ধার্মিকতার করে না আড়ম্বর। শ্রদ্ধা করিয়া জ্বালে বুদ্ধির আলো, শাস্ত্রে মানে না, মানে মানুষের ভালো। বিধর্ম বলি মারে পরধর্মেরে, নিজ ধর্মের অপমান করি ফেরে, পিতার নামেতে হানে তাঁর সন্তানে, আচার লইয়া বিচার নাহিকো জানে, পূজাগৃহে তোলে রক্তমাখানো ধ্বজা, -- দেবতার নামে এ যে শয়তান ভজা। অনেক যুগের লজ্জা ও লাঞ্ছনা, বর্বরতার বিকারবিড়ম্বনা ধর্মের মাঝে আশ্রয় দিল যারা আবর্জনায় রচে তারা নিজ কারা। -- প্রলয়ের ওই শুনি শৃঙ্গধ্বনি, মহাকাল আসে লয়ে সম্মার্জনী। যে দেবে মুক্তি তারে খুঁটিরূপে গাড়া, যে মিলাবে তারে করিল ভেদের খাঁড়া, যে আনিবে প্রেম অমৃত-উৎস হতে তারি নামে ধরা ভাসায় বিষের স্রোতে, তরী ফুটা করি পার হতে গিয়ে ডোবে -- তবু এরা কারে অপবাদ দেয় ক্ষোভে। হে ধর্মরাজ, ধর্মবিকার নাশি ধর্মমূঢ়জনেরে বাঁচাও আসি। যে পূজার বেদি রক্তে গিয়েছে ভেসে ভাঙো ভাঙো, আজি ভাঙো তারে নিঃশেষে -- ধর্মকারার প্রাচীরে বজ্র হানো, এ অভাগা দেশে জ্ঞানের আলোক আনো।
পথের পথিক করেছ আমায় সেই ভালো ওগো, সেই ভালো। আলেয়া জ্বালালে প্রান্তরভালে সেই আলো মোর সেই আলো। ঘাটে বাঁধা ছিল খেয়াতরী, তাও কি ডুবালে ছল করি। সাঁতারিয়া পার হব বহি ভার সেই ভালো মোর সেই ভালো। ঝড়ের মুখে যে ফেলেছ আমায় সেই ভালো ওগো, সেই ভালো। সব সুখজালে বজ্র জ্বালালে সেই আলো মোর সেই আলো। সাথি যে আছিল নিলে কাড়ি-- কী ভয় লাগালে, গেল ছাড়ি-- একাকীর পথে চলিব জগতে সেই ভালো মোর সেই ভালো। কোনো মান তুমি রাখ নি আমার সেই ভালো ওগো, সেই ভালো। হৃদয়ের তলে যে আগুন জ্বলে সেই আলো মোর সেই আলো। পাথেয় যে ক'টি ছিল কড়ি পথে খসি কবে গেছে পড়ি, শুধু নিজবল আছে সম্বল সেই ভালো মোর সেই ভালো।