যখন দিনের শেষে চেয়ে দেখি সমুখপানে সূর্য ডোবার দেশে মনের মধ্যে ভাবি অস্তসাগর-তলায় গেছে নাবি অনেক সূর্য-ডোবার সঙ্গে অনেক আনাগোনা, অনেক দেখাশোনা, অনেক কীর্তি, অনেক মূর্তি, অনেক দেবালয়, শক্তিমানের অনেক পরিচয়। তাদের হারিয়ে-যাওয়ার ব্যাথায় টান লাগে না মনে, কিন্তু যখন চেয়ে দেখি সামনে সবুজ বনে ছায়ায় চরছে গোরু, মাঝ দিয়ে তার পথ গিয়েছে সরু, ছেয়ে আছে শুক্নো বাঁশের পাতায়, হাট করতে চলে মেয়ে ঘাসের আঁঠি মাথায়, তখন মনে হঠাৎ এসে এই বেদনাই বাজে-- ঠাঁই রবে না কোনোকালেই ঐ যা-কিছুর মাঝে। ঐ যা-কিছুর ছবির ছায়া দুলেছে কোন্কালে শিশুর-চিত্ত-নাচিয়ে-তোলা ছড়াগুলির তালে-- তিরপূর্নির চরে বালি ঝুর্ঝুর্ করে, কোন্ মেয়ে সে চিকন-চিকন চুল দিচ্ছে ঝাড়ি, পরনে তার ঘুরে-পড়া ডুরে একটি শাড়ি। ঐ যা-কিছু ছবির আভাস দেখি সাঁঝের মুখে মর্ত্যধরার পিছু-ডাকা দোলা লাগায় বুকে।
অনেক হল দেরি, আজো তবু দীর্ঘ পথের অন্ত নাহি হেরি। তখন ছিল দখিন হাওয়া আধ-ঘুমো আধ-জাগা, তখন ছিল সর্ষে-খেতে ফুলের আগুন লাগা, তখন আমি মালা গেঁথে পদ্মপাতায় ঢেকে পথে বাহির হয়েছিলেম রুদ্ধ কুটির থেকে। অনেক হল দেরি, আজো তবু দীর্ঘ পথের অন্ত নাহি হেরি। বসন্তের সে মালা আজ কি তেমন গন্ধ দেবে নবীন-সুধা-ঢালা? আজকে বহে পুবে বাতাস, মেঘে আকাশ জুড়ে-- ধানের খেতে ঢেউ উঠেছে নব-নবাঙ্কুরে। হাওয়ায় হাওয়ায় নাইকো রে হায় হালকা সে হিল্লোল, নাই বাগানে হাস্যে গানে পাগল গণ্ডগোল। অনেক হল দেরি, আজো তবু দীর্ঘ পথের অন্ত নাহি হেরি। হল কালের ভুল, পুবে হাওয়ায় ধরে দিলেম দখিন হাওয়ার ফুল। এখন এল অন্য সুরে অন্য গানের পালা, এখন গাঁথো অন্য ফুলে অন্য ছাঁদের মালা। বাজছে মেঘের গুরু গুরু, বাদল ঝরো ঝরো-- সজল বায়ে কদম্ববন কাঁপছে থরোথরো। অনেক হল দেরি, আজো তবু দীর্ঘ পথের অন্ত নাহি হেরি।