তোমারে ডাকিনু যবে কুঞ্জবনে তখনো আমের বনে গন্ধ ছিল। জানি না কী লাগি ছিলে অন্যমনে, তোমার দুয়ার কেন বন্ধ ছিল। একদিন শাখাভরি এল ফলগুচ্ছ, ভরা অঞ্জলি মোর করি গেলে তুচ্ছ, পূর্ণতা-পানে আঁখি অন্ধ ছিল। বৈশাখে অকরুণ দারুণ ঝড়ে সোনার বরন ফল খসিয়া পড়ে। কহিনু, "ধুলায় লোটে মোর যত অর্ঘ্য, তব করতলে যেন পায় তার স্বর্গ।' হায় রে, তখনো মনে দ্বন্দ্ব ছিল। তোমার সন্ধ্যা ছিল প্রদীপহীনা, আঁধারে দুয়ারে তব বাজানু বীণা। তারার আলোক-সাথে মিলি মোর চিত্ত ঝংকৃত তারে তারে করেছিল নৃত্য, তোমার হৃদয় নিস্পন্দ ছিল।
তন্দ্রাবিহীন নীড়ে ব্যাকুল পাখি হারায়ে কাহারে বৃথা মরিল ডাকি। প্রহর অতীত হল, কেটে গেল লগ্ন, একা ঘরে তুমি ঔদাস্যে নিমগ্ন, তখনো দিগঞ্চলে চন্দ্র ছিল। কে বোঝে কাহার মন! অবোধ হিয়া দিতে চেয়েছিল বাণী নিঃশেষিয়া। আশা ছিল, কিছু বুঝি আছে অতিরিক্ত অতীতের স্মৃতিখানি অশ্রুতে সিক্ত-- বুঝিবা নূপুরে কিছু ছন্দ ছিল। উষার চরণতলে মলিন শশী রজনীর হার হতে পড়িল খসি। বীণার বিলাপ কিছু দিয়েছে কি সঙ্গ, নিদ্রার তটতলে তুলেছে তরঙ্গ, স্বপ্নেও কিছু কি আনন্দ ছিল।
অলস মনের আকাশেতে প্রদোষ যখন নামে, কর্মরথের ঘড়্ঘড়ানি যে-মুহূর্তে থামে, এলোমেলো ছিন্নচেতন টুকরো কথার ঝাঁক জানি নে কোন্ স্বপ্নরাজের শুনতে যে পায় ডাক, ছেড়ে আসে কোথা থেকে দিনের বেলার গর্ত-- কারো আছে ভাবের আভাস কারো বা নেই অর্থ-- ঘোলা মনের এই যে সৃষ্টি, আপন অনিয়মে ঝিঁঝির ডাকে অকারণের আসর তাহার জমে। একটুখানি দীপের আলো শিখা যখন কাঁপায় চার দিকে তার হঠাৎ এসে কথার ফড়িং ঝাঁপায়। পষ্ট আলোর সৃষ্টি-পানে যখন চেয়ে দেখি মনের মধ্যে সন্দেহ হয় হঠাৎ মাতন এ কি। বাইরে থেকে দেখি একটা নিয়ম-ঘেরা মানে, ভিতরে তার রহস্য কী কেউ তা নাহি জানে। খেয়াল-স্রোতের ধারায় কী সব ডুবছে এবং ভাসছে-- ওরা কী-যে দেয় না জবাব, কোথা থেকে আসছে। আছে ওরা এই তো জানি, বাকিটা সব আঁধার-- চলছে খেলা একের সঙ্গে আর-একটাকে বাঁধার। বাঁধনটাকেই অর্থ বলি, বাঁধন ছিঁড়লে তারা কেবল পাগল বস্তুর দল শূন্যেতে দিক্হারা।