যখন আমায় হাতে ধরে আদর করে ডাকলে তুমি আপন পাশে, রাত্রিদিবস ছিলেম ত্রাসে পাছে তোমার আদর হতে অসাবধানে কিছু হারাই, চলতে গিয়ে নিজের পথে যদি আপন ইচ্ছামতে কোনো দিকে এক পা বাড়াই, পাছে বিরাগ-কুশাঙ্কুরের একটি কাঁটা একটু মাড়াই। মুক্তি, এবার মুক্তি আজি উঠল বাজি অনাদরের কঠিন ঘায়ে, অপমানের ঢাকে ঢোলে সকল নগর সকল গাঁয়ে। ওরে ছুটি, এবার ছুটি, এই যে আমার হল ছুটি, ভাঙল আমার মানের খুঁটি, খসল বেড়ি হাতে পায়ে; এই যে এবার দেবার নেবার পথ খোলসা ডাইনে বাঁয়ে। এতদিনে আবার মোরে বিষম জোরে ডাক দিয়েছে আকাশ পাতাল। লাঞ্ছিতেরে কে রে থামায়। ঘর-ছাড়ানো বাতাস আমায় মুক্তি-মদে করল মাতাল। খসে-পড়া তারার সাথে নিশীথরাতে ঝাঁপ দিয়েছি অতলপানে মরণ-টানে। আমি-যে সেই বৈশাখী মেঘ বাঁধনছাড়া, ঝড় তাহারে দিল তাড়া; সন্ধ্যারবির স্বর্ণকিরীট ফেলে দিল অস্তপারে, বজ্রমানিক দুলিয়ে নিল গলার হারে; একলা আপন তেজে ছুটল সে-যে অনাদরের মুক্তিপথের 'পরে তোমার চরণধুলায়-রঙিন চরম সমাদরে। গর্ভ ছেড়ে মাটির 'পরে যখন পড়ে তখন ছেলে দেখে আপন মাকে। তোমার আদর যখন ঢাকে, জড়িয়ে থাকি তারি নাড়ীর পাকে, তখন তোমায় নাহি জানি। আঘাত হানি তোমারি আচ্ছাদন হতে যেদিন দূরে ফেলাও টানি সে-বিচ্ছেদে চেতনা দেয় আনি, দেখি বদনখানি।
যারে সে বেসেছে ভালো তারে সে কাঁদায়। নূতন ধাঁধায় ক্ষণে ক্ষণে চমকিয়া দেয় তারে, কেবলই আলো-আঁধারে সংশয় বাধায়; ছল-করা অভিমানে বৃথা সে সাধায়। সে কি শরতের মায়া উড়ো মেঘে নিয়ে আসে বৃষ্টিভরা ছায়া। অনুকূল চাহনির তলে কী বিদ্যুৎ ঝলে। কেন দয়িতের মিনতিকে অভাবিত উচ্চ হাস্যে উড়াইয়া দেয় দিকে দিকে। তার পরে আপনার নির্দয় লীলায় আপনি সে ব্যথা পায়, ফিরে যে গিয়েছে তারে ফিরায়ে ডাকিতে কাঁদে প্রাণ; আপনার অভিমানে করে খানখান। কেন তার চিত্তাকাশে সারা বেলা পাগল হাওয়ার এই এলোমেলো খেলা। আপনি সে পারে না বুঝিতে যেদিকে চলিতে চায় কেন তার চলে বিপরীতে। গভীর অন্তরে যেন আপনার অগোচরে আপনার সাথে তার কী আছে বিরোধ, অন্যেরে আঘাত করে আত্মঘাতী ক্রোধ; মুহূর্তেই বিগলিত করুণায় অপমানিতের পায় প্রাণমন দেয় ঢালি-- নাম কি হেঁয়ালী।
খোকার মনের ঠিক মাঝখানটিতে আমি যদি পারি বাসা নিতে-- তবে আমি একবার জগতের পানে তার চেয়ে দেখি বসি সে নিভৃতে। তার রবি শশী তারা জানি নে কেমনধারা সভা করে আকাশের তলে, আমার খোকার সাথে গোপনে দিবসে রাতে শুনেছি তাদের কথা চলে। শুনেছি আকাশ তারে নামিয়া মাঠের পারে লোভায় রঙিন ধনু হাতে, আসি শালবন-'পরে মেঘেরা মন্ত্রণা করে খেলা করিবারে তার সাথে। যারা আমাদের কাছে নীরব গম্ভীর আছে, আশার অতীত যারা সবে, খোকারে তাহারা এসে ধরা দিতে চায় হেসে কত রঙে কত কলরবে। খোকার মনের ঠিক মাঝখান ঘেঁষে যে পথ গিয়েছে সৃষ্টিশেষে সকল-উদ্দেশ-হারা সকল-ভূগোল-ছাড়া অপরূপ অসম্ভব দেশে-- যেথা আসে রাত্রিদিন সর্ব-ইতিহাস-হীন রাজার রাজত্ব হতে হাওয়া, তারি যদি এক ধারে পাই আমি বসিবারে দেখি কারা করে আসা-যাওয়া। তাহারা অদ্ভুত লোক, নাই কারো দুঃখ শোক, নেই তারা কোনো কর্মে কাজে, চিন্তাহীন মৃত্যুহীন চলিয়াছে চিরদিন খোকাদের গল্পলোক-মাঝে। সেথা ফুল গাছপালা নাগকন্যা রাজবালা মানুষ রাক্ষস পশু পাখি, যাহা খুশি তাই করে, সত্যেরে কিছু না ডরে, সংশয়েরে দিয়ে যায় ফাঁকি।