ভালোবাসা এসেছিল এমন সে নিঃশব্দ চরণে তারে স্বপ্ন হয়েছিল মনে, দিই নি আসন বসিবার। বিদায় সে নিল যবে, খুলিতেই দ্বার শব্দ তার পেয়ে, ফিরায়ে ডাকিতে গেনু ধেয়ে। তখন সে স্বপ্ন কায়াহীন, নিশীথে বিলীন, দূরপথে তার দীপশিখা একটি রক্তিম মরীচিকা।
ভিড় করেছে রঙমশালীর দলে। কেউ-বা জলে কেউ-বা তারা স্থলে। অজানা দেশ, রাত্রিদিনে পায়ের কাছের পথটি চিনে দুঃসাহসে এগিয়ে তারা চলে। কোন্ মহারাজ রথের 'পরে একা, ভালো করে যায় না তাঁরে দেখা। সূর্যতারা অন্ধকারে ডাইনে বাঁয়ে উঁকি মারে, আপন আলোয় দৃষ্টি তাদের ঠেকা। আমার মশাল সামনে ধরি না যে, তাই তো আলো চক্ষে নাহি বাজে। অন্তরে মোর রঙের শিখা চিত্তকে দেয় আপন টিকা, রঙিনকে তাই দেখি মনের মাঝে। পাখিরা রঙ ওড়ায় আকাশতলে, মাছেরা রঙ খেলায় গভীর জলে। রঙ জেগেছে বনসভায় গোলাপ চাঁপা রঙন জবায়, মেঘেরা রঙ ফোটায় পলে পলে।
নীরব ডাকে রঙমহালের রাজা হুকুম করেন, "রঙের আসর সাজা।'-- অমনি ফাগুন কোথা হতে ভেসে আসে হাওয়ার স্রোতে, পুরানোকে রাঙিয়ে করে তাজা। তাদের আসর বাহির-ভুবনেতে, ফেরে সেথায় রঙের নেশায় মেতে। আমার এ রঙ গোপন প্রাণে, আমার এ রঙ গভীর গানে, রঙের আসন ধেয়ানে দিই পেতে।
তোমাকে পাঠালুম আমার লেখা এক-বই-ভরা কবিতা তারা সবাই ঘেঁষাঘেঁষি দেখা দিল একই সঙ্গে এক খাঁচায়। কাজেই আর সমস্ত পাবে, কেবল পাবে না তাদের মাঝখানের ফাঁকগুলোকে। যে অবকাশের নীল আকাশের আসরে একদিন নামল এসে কবিতা সেইটেই পড়ে রইল পিছনে। নিশীথ রাত্রের তারাগুলি ছিঁড়ে নিয়ে যদি হার গাঁথা যায় ঠেসে, বিশ্ব-বেনের দোকানে হয়তো সেটা বিকোয় মোটা দামে; তবু রসিকেরা বুঝতে পারে, যেন কমতি হল কিসের। যেটা কম পড়ল সেটা ফাঁকা আকাশ, তৌল করা যায় না তাকে, কিন্তু সেটা দরদ দিয়ে ভরা। মনে করো একটি গান উঠল জেগে নীরব সময়ের বুকের মাঝখানে একটি মাত্র নীলকান্তমণি-- তাকে কি দেখতে হবে গয়নার বাক্সের মধ্যে। বিক্রমাদিত্যের সভায় কবিতা শুনিয়েছেন কবি দিনে দিনে। ছাপাখানার দৈত্য তখন কবিতার সময়াকাশকে দেয় নি লেপে কালি মাখিয়ে। হাইড্রলিক জাঁতায় পেষা কাব্যপিণ্ড তলিয়ে যেত না গলায় এক-এক গ্রাসে, উপভোগটা পুরো অবসরে উঠত রসিয়ে। হায় রে, কানে শোনার কবিতাকে পরানো হল চোখে দেখার শিকল, কবিতার নির্বাসন হল লাইব্রেরি-লোকে; নিত্যকালের আদরের ধন পাব্লিশরের হাটে হল নাকাল। উপায় নেই, জটলা-পাকানোর যুগ এটা। কবিতাকে পাঠকের অভিসারে যেতে হয় পটল-ডাঙার অম্নিবাসে চড়ে। মন বলছে নিশ্বাস ফেলে-- আমি যদি জন্ম নিতেম কালিদাসের কালে। তুমি যদি হতে বিক্রমাদিত্য আর আমি যদি হতেম-- কী হবে ব'লে। জন্মেছি ছাপার কালিদাস হয়ে। তোমরা আধুনিক মালবিকা কিনে পড় কবিতা আরাম-কেদারায় ব'সে। চোখ বুজে কান পেতে শোন না; শোনা হলে কবিকে পরিয়ে দাও না বেলফুলের মালা, দোকানে পাঁচ সিকে দিয়েই খালাস।