আজ এ মনের কোন্ সীমানায় যুগান্তরের প্রিয়া। দূরে-উড়ে-যাওয়া মেঘের ছিদ্র দিয়া কখনো আসিছে রৌদ্র কখনো ছায়া, আমার জীবনে তুমি আজ শুধু মায়া; সহজে তোমায় তাই তো মিলাই সুরে, সহজেই ডাকি সহজেই রাখি দূরে। স্বপ্নরূপিণী তুমি আকুলিয়া আছ পথ-খোওয়া মোর প্রাণের স্বর্গভূমি। নাই কোনো ভার, নাই বেদনার তাপ, ধূলির ধরায় পড়ে না পায়ের ছাপ। তাই তো আমার ছন্দে সহসা তোমার চুলের ফুলের গন্ধে জাগে নির্জন রাতের দীর্ঘশ্বাস, জাগে প্রভাতের পেলব তারায় বিদায়ের স্মিত হাস। তাই পথে যেতে কাশের বনেতে মর্মর দেয় আনি পাশ-দিয়ে-চলা ধানী-রঙ-করা শাড়ির পরশখানি। যদি জীবনের বর্তমানের তীরে আস কভু তুমি ফিরে স্পষ্ট আলোয়, তবে জানি না তোমার মায়ার সঙ্গে কায়ার কি মিল হবে। বিরহস্বর্গলোকে সে-জাগরণের রূঢ় আলোয় চিনিব কি চোখে-চোখে। সন্ধ্যাবেলায় যে-দ্বারে দিয়েছ বিরহকরুণ নাড়া, মিলনের ঘায়ে সে-দ্বার খুলিলে কাহারো কি পাবে সাড়া।
যারে সে বেসেছে ভালো তারে সে কাঁদায়। নূতন ধাঁধায় ক্ষণে ক্ষণে চমকিয়া দেয় তারে, কেবলই আলো-আঁধারে সংশয় বাধায়; ছল-করা অভিমানে বৃথা সে সাধায়। সে কি শরতের মায়া উড়ো মেঘে নিয়ে আসে বৃষ্টিভরা ছায়া। অনুকূল চাহনির তলে কী বিদ্যুৎ ঝলে। কেন দয়িতের মিনতিকে অভাবিত উচ্চ হাস্যে উড়াইয়া দেয় দিকে দিকে। তার পরে আপনার নির্দয় লীলায় আপনি সে ব্যথা পায়, ফিরে যে গিয়েছে তারে ফিরায়ে ডাকিতে কাঁদে প্রাণ; আপনার অভিমানে করে খানখান। কেন তার চিত্তাকাশে সারা বেলা পাগল হাওয়ার এই এলোমেলো খেলা। আপনি সে পারে না বুঝিতে যেদিকে চলিতে চায় কেন তার চলে বিপরীতে। গভীর অন্তরে যেন আপনার অগোচরে আপনার সাথে তার কী আছে বিরোধ, অন্যেরে আঘাত করে আত্মঘাতী ক্রোধ; মুহূর্তেই বিগলিত করুণায় অপমানিতের পায় প্রাণমন দেয় ঢালি-- নাম কি হেঁয়ালী।
যারা আমার সাঁঝসকালের গানের দীপে জ্বালিয়ে দিলে আলো আপন হিয়ার পরশ দিয়ে; এই জীবনের সকল সাদা কালো যাদের আলোক-ছায়ার লীলা; মনের মানুষ বাইরে বেড়ায় যারা তাদের প্রাণের ঝরনা-স্রোতে আমার পরান হয়ে হাজার ধারা চলছে বয়ে চতুর্দিকে। নয় তো কেবল কালের যোগে আয়ু, নয় সে কেবল দিনরজনীর সাতনলি হার, নয় সে নিশাস-বায়ু। নানান প্রাণের প্রীতির মিলন নিবিড় হয়ে স্বজনবন্ধুজনে পরমায়ুর পাত্রখানি জীবনসুধায় ভরছে ক্ষণে ক্ষণে। একের বাঁচন সবার বাঁচার বন্যাবেগে আপন সীমা হারায় বহুদূরে; নিমেষগুলির ফলের গুচ্ছ ভরে রসের ধারায়। অতীত হয়ে তবুও তারা বর্তমানের বৃন্তদোলায় দোলে,-- গর্ভ-বাঁধন কাটিয়ে শিশু তবু যেমন মায়ের বক্ষে কোলে বন্দী থাকে নিবিড় প্রেমের গ্রন্থি দিয়ে। তাই তো যখন শেষে একে একে আপন জনে সূর্য-আলোর অন্তরালের দেশে আঁখির নাগাল এড়িয়ে পালায়, তখন রিক্ত শুষ্ক জীবন মম শীর্ণ রেখায় মিলিয়ে আসে বর্ষাশেষের নির্ঝরিণীসম শূন্য বালুর একটি প্রান্তে ক্লান্ত সলিল স্রস্ত অবহেলায়। তাই যারা আজ রইল পাশে এই জীবনের সূর্য-ডোবার বেলায় তাদের হাতে হাত দিয়ে তুই গান গেয়ে নে থাকতে দিনের আলো-- ব'লে নে ভাই, এই যে দেখা এই যে ছোঁওয়া, এই ভালো এই ভালো। এই ভালো আজ এ সংগমে কান্নাহাসির গঙ্গাযমুনায় ঢেউ খেয়েছি, ডুব দিয়েছি, ঘট ভরেছি, নিয়েছি বিদায়। এই ভালো রে ফুলের সঙ্গে আলোয় জাগা, গান গাওয়া এই ভাষায়; তারার সাথে নিশীথ রাতে ঘুমিয়ে-পড়া নূতন প্রাণের আশায়।