আমার এ গান শুনবে তুমি যদি শোনাই কখন বলো। ভরা চোখের মতো যখন নদী করবে ছলছল, ঘনিয়ে যখন আসবে মেঘের ভার বহু কালের পরে, না যেতে দিন সজল অন্ধকার নামবে তোমার ঘরে, যখন তোমার কাজ কিছু নেই হাতে, তবুও বেলা আছে, সাথি তোমার আসত যারা রাতে আসে নি কেউ কাছে, তখন আমায় মনে পড়ে যদি গাইতে যদি বল-- নবমেঘের ছায়ায় যখন নদী করবে ছলছল। ম্লান আলোয় দখিন-বাতায়নে বসবে তুমি একা-- আমি গাব বসে ঘরের কোণে, যাবে না মুখ দেখা। ফুরাবে দিন, আঁধার ঘন হবে, বৃষ্টি হবে শুরু-- উঠবে বেজে মৃদুগভীর রবে মেঘের গুরুগুরু। ভিজে পাতার গন্ধ আসবে ঘরে, ভিজে মাটির বাস-- মিলিয়ে যাবে বৃষ্টির ঝর্ঝরে বনের নিশ্বাস। বাদল-সাঁঝে আঁধার বাতায়নে বসবে তুমি একা-- আমি গেয়ে যাব আপন-মনে, যাবে না মুখ দেখা। জলের ধারা ঝরবে দ্বিগুণ বেগে, বাড়বে অন্ধকার-- নদীর ধারে বনের সঙ্গে মেঘে ভেদ রবে না আর। কাঁসর ঘণ্টা দূরে দেউল হতে জলের শব্দে মিশে আঁধার পথে ঝোড়ো হাওয়ার স্রোতে ফিরবে দিশে দিশে। শিরীষফুলের গন্ধ থেকে থেকে আসবে জলের ছাঁটে, উচ্চরবে পাইক যাবে হেঁকে গ্রামের শূন্য বাটে। জলের ধারা ঝরবে বাঁশের বনে, বাড়বে অন্ধকার-- গানের সাথে বাদলা রাতের সনে ভেদ রবে না আর। ও ঘর হতে যবে প্রদীপ জ্বেলে আনবে আচম্বিত সেতারখানি মাটির 'পরে ফেলে থামাব মোর গীত। হঠাৎ যদি মুখ ফিরিয়ে তবে চাহ আমার পানে এক নিমিষে হয়তো বুঝে লবে কী আছে মোর গানে। নামায়ে মুখ নয়ন করে নিচু বাহির হয়ে যাব, একলা ঘরে যদি কোনো-কিছু আপন-মনে ভাব। থামিয়ে গান আমি চলে গেলে যদি আচম্বিত বাদল-রাতে আঁধারে চোখ মেলে শোন আমার গীত।
মেঘের 'পরে মেঘ জমেছে, আঁধার করে আসে, আমায় কেন বসিয়ে রাখ একা দ্বারের পাশে। কাজের দিনে নানা কাজে থাকি নানা লোকের মাঝে, আজ আমি যে বসে আছি তোমারি আশ্বাসে। আমায় কেন বসিয়ে রাখ একা দ্বারের পাশে। তুমি যদি না দেখা দাও, কর আমায় হেলা, কেমন করে কাটে আমার এমন বাদল-বেলা। দূরের পানে মেলে আঁখি কেবল আমি চেয়ে থাকি, পরান আমার কেঁদে বেড়ায় দুরন্ত বাতাসে। আমায় কেন বসিয়ে রাখ একা দ্বারের পাশে।
ছবি ও গান নিয়ে আমার বলবার কথাটা বলে নিই। এটা বয়ঃসন্ধিকালের লেখা, শৈশব যৌবন যখন সবে মিলেছে। ভাষায় আছে ছেলেমানুষি, ভাবে এসেছে কৈশোর। তার পূর্বেকার অবস্থায় একটা বেদনা ছিল অনুদ্দিষ্ট, সে যেন প্রলাপ ব'কে আপনাকে শান্ত করতে চেয়েছে। এখন সেই বয়স যখন কামনা কেবল সুর খুঁজছে না, রূপ খুঁজতে বেরিয়েছে। কিন্তু আলো-আঁধারে রূপের আভাস পায়, স্পষ্ট করে কিছু পায় না। ছবি এঁকে তখন প্রত্যক্ষতার স্বাদ পাবার ইচ্ছা জেগেছে মনে কিন্তু ছবি আঁকবার হাত তৈরি হয় নি তো। কবি সংসারের ভিতরে তখনও প্রবেশ করে নি, তখনও সে বাতায়নবাসী। দূর থেকে যার আভাস দেখে তার সঙ্গে নিজের মনের নেশা মিলিয়ে দেয়। এর কোনো-কোনোটা চোখে দেখা একটুকরো ছবি পেনসিলে আঁকা, রবারে ঘষে দেওয়া, আর কোনো-কোনোটা সম্পূর্ণ বানানো। মোটের উপরে অক্ষম ভাষার ব্যাকুলতায় সবগুলিতেই বানানো ভাব প্রকাশ পেয়েছে, সহজ হয় নি। কিন্তু সহজ হবার একটা চেষ্টা দেখা যায়। সেইজন্যে চলতি ভাষা আপন এলোমেলো পদক্ষেপে এর যেখানে-সেখানে প্রবেশ করেছে। আমার ভাষায় ও ছন্দে এই একটা মেলামেশা আরম্ভ হল। ছবি ও গান কড়ি ও কোমলের ভূমিকা করে দিলে।