স্নেহ-উপহার এনে দিতে চাই, কী যে দেব তাই ভাবনা -- যত দিতে সাধ করি মনে মনে খুঁজে-পেতে সে তো পাব না। আমার যা ছিল ফাঁকি দিয়ে নিতে সবাই করেছে একতা, বাকি যে এখন আছে কত ধন না তোলাই ভালো সে কথা। সোনা রুপো আর হীরে জহরত পোঁতা ছিল সব মাটিতে, জহরি যে যত সন্ধান পেয়ে নে গেছে যে যার বাটীতে। টাকাকড়ি মেলা আছে টাকশালে, নিতে গেলে পড়ি বিপদে। বসনভূষণ আছে সিন্দুকে, পাহারাও আছে ফি পদে। এ যে সংসারে আছি মোরা সবে এ বড়ো বিষম দেশ রে। ফাঁকিফুঁকি দিয়ে দূরে চ'লে গিয়ে ভুলে গিয়ে সব শেষ রে। ভয়ে ভয়ে তাই স্মরণচিহ্ন যে যাহারে পারে দেয় যে। তাও কত থাকে, কত ভেঙে যায়, কত মিছে হয় ব্যয় যে। স্নেহ যদি কাছে রেখে যাওয়া যেত, চোখে যদি দেখা যেত রে, কতগুলো তবে জিনিস-পত্র বল্ দেখি দিত কে তোরে। তাই ভাবি মনে কী ধন আমার দিয়ে যাব তোরে নুকিয়ে, খুশি হবি তুই, খুশি হব আমি, বাস্, সব যাবে চুকিয়ে। কিছু দিয়ে-থুয়ে চিরদিন-তরে কিনে রেখে দেব মন তোর -- এমন আমার মন্ত্রণা নেই, জানি নে ও হেন মন্তর। নবীন জীবন, বহুদূর পথ পড়ে আছে তোর সুমুখে; স্নেহরস মোরা যেটুকু যা দিই পিয়ে নিস এক চুমুকে। সাথিদলে জুটে চলে যাস ছুটে নব আশে নব পিয়াসে, যদি ভুলে যাস, সময় না পাস, কী যায় তাহাতে কী আসে। মনে রাখিবার চির-অবকাশ থাকে আমাদেরই বয়সে, বাহিরেতে যার না পাই নাগাল অন্তরে জেগে রয় সে। পাষাণের বাধা ঠেলেঠুলে নদী আপনার মনে সিধে সে কলগান গেয়ে দুই তীর বেয়ে যায় চলে দেশ-বিদেশে -- যার কোল হতে ঝরনার স্রোতে এসেছে আদরে গলিয়া তারে ছেড়ে দূরে যায় দিনে দিনে অজানা সাগরে চলিয়া। অচল শিখর ছোটো নদীটিরে চিরদিন রাখে স্মরণে -- যতদূর যায় স্নেহধারা তার সাথে যায় দ্রুতচরণে। তেমনি তুমিও থাক না'ই থাক, মনে কর মনে কর না, পিছে পিছে তব চলিবে ঝরিয়া আমার আশিস-ঝরনা॥
ছুটি হলে রোজ ভাসাই জলে কাগজ-নৌকাখানি। লিখে রাখি তাতে আপনার নাম লিখি আমাদের বাড়ি কোন্ গ্রাম বড়ো বড়ো ক'রে মোটা অক্ষরে, যতনে লাইন টানি। যদি সে নৌকা আর-কোনো দেশে আর-কারো হাতে পড়ে গিয়ে শেষে আমার লিখন পড়িয়া তখন বুঝিবে সে অনুমানি কার কাছ হতে ভেসে এল স্রোতে কাগজ-নৌকাখানি। আমার নৌকা সাজাই যতনে শিউলি বকুলে ভরি। বাড়ির বাগানে গাছের তলায় ছেয়ে থাকে ফুল সকালবেলায়, শিশিরের জল করে ঝলমল প্রভাতের আলো পড়ি। সেই কুসুমের অতি ছোটো বোঝা কোন্ দিক-পানে চলে যায় সোজা, বেলাশেষে যদি পার হয়ে নদী ঠেকে কোনোখানে যেয়ে-- প্রভাতের ফুল সাঁঝে পাবে কূল কাগজের তরী বেয়ে। আমার নৌকা ভাসাইয়া জলে চেয়ে থাকি বসি তীরে। ছোটো ছোটো ঢেউ ওঠে আর পড়ে, রবির কিরণে ঝিকিমিকি করে, আকাশেতে পাখি চলে যায় ডাকি, বায়ু বহে ধীরে ধীরে। গগনের তলে মেঘ ভাসে কত আমারি সে ছোটো নৌকার মতো-- কে ভাসালে তায়, কোথা ভেসে যায়, কোন্ দেশে গিয়ে লাগে। ওই মেঘ আর তরণী আমার কে যাবে কাহার আগে। বেলা হলে শেষে বাড়ি থেকে এসে নিয়ে যায় মোরে টানি; আমি ঘরে ফিরি, থাকি কোণে মিশি, যেথা কাটে দিন সেথা কাটে নিশি-- কোথা কোন্ গাঁয় ভেসে চলে যায় আমার নৌকাখানি। কোন্ পথে যাবে কিছু নাই জানা, কেহ তারে কভু নাহি করে মানা, ধরে নাহি রাখে, ফিরে নাহি ডাকে-- ধায় নব নব দেশে। কাগজের তরী, তারি 'পরে চড়ি মন যায় ভেসে ভেসে। রাত হয়ে আসে, শুই বিছানায়, মুখ ঢাকি দুই হাতে-- চোখ বুজে ভাবি-- এমন আঁধার, কালি দিয়ে ঢালা নদীর দু ধার তারি মাঝখানে কোথায় কে জানে নৌকা চলেছে রাতে। আকাশের তারা মিটি-মিটি করে, শিয়াল ডাকিছে প্রহরে প্রহরে, তরীখানি বুঝি ঘর খুঁজি খুঁজি তীরে তীরে ফিরে ভাসি। ঘুম লয়ে সাথে চড়েছে তাহাতে ঘুমপাড়ানিয়া মাসি।