এখনো ভাঙে নি ভাঙে নি মেলা নদীর তীরের মেলা। এ শুধু আষাঢ়-মেঘের আঁধার, এখনো রয়েছে বেলা। ভেবেছিনু দিন মিছে গোঙালেম, যাহা ছিল বুঝি সবই খোয়ালেম, আছে আছে তবু, আছে ভাই, কিছু রয়েছে বাকি। আমারো ভাগ্যে আজ ঘটে নাই কেবলি ফাঁকি। বেচিবার যাহা বেচা হয়ে গেছে কিনিবার যাহা কেনা, আমি তো চুকিয়ে দিয়েছি নিয়েছি সকল পাওনা দেনা। দিন না ফুরাতে ফিরিব এখন-- প্রহরী চাহিছ পসরার পণ? ভয় নাই ওগো, আছে আছে, কিছু রয়েছে বাকি। আমারো ভাগ্যে ঘটে নি ঘটে নি কেবলি ফাঁকি। কখন বাতাস মাতিয়া আবার মাথায় আকাশ ভাঙে! কখন সহসা নামিবে বাদল, তুফান উঠিবে গাঙে! তাই ছুটাছুটি চলিয়াছে ধেয়ে-- পারানির কড়ি চাহ তুমি নেয়ে? কিসের ভাবনা, আছে আছে, কিছু রয়েছে বাকি। আমারো ভাগ্যে ঘটে নি ঘটে নি কেবলি ফাঁকি। ধান-খেত বেয়ে বাঁকা পথখানি, গিয়েছে গ্রামের পারে। বৃষ্টি আসিতে দাঁড়ায়েছিলেম নিরালা কুটিরদ্বারে। থামিল বাদল, চলিনু এবার-- হে দোকানি, চাও মূল্য তোমার? ভয় নাই ভাই, আছে আছে, কিছু রয়েছে বাকি। আমারো ভাগ্যে ঘটে নি ঘটে নি সকলি ফাঁকি। পথের প্রান্তে বটের তলায় বসে আছ এইখানে-- হায় গো ভিখারি, চাহিছ কাতরে আমারো মুখের পানে! ভাবিতেছ মনে বেচা-কেনা সেরে কত লাভ করে চলিয়াছে কে রে! আছে আছে বটে, আছে ভাই, কিছু রয়েছে বাকি। আমারো ভাগ্যে ঘটে নি ঘটে নি সকলি ফাঁকি। আঁধার রজনী, বিজন এ পথ, জোনাকি চমকে গাছে। কে তুমি আমার সঙ্গ ধরেছ, নীরবে চলেছ পাছে? এ ক'টি কড়ির মিছে ভার বওয়া, তোমাদের প্রথা কেড়েকুড়ে লওয়া-- হবে না নিরাশ, আছে আছে, কিছু রয়েছে বাকি। আমারো ভাগ্যে ঘটে নি ঘটে নি কেবলি ফাঁকি। নিশি দু-পহর, পঁহুছিনু ঘর দু-হাত রিক্ত করি, তুমি আছ একা সজলনয়নে দাঁড়ায়ে দুয়ার ধরি। চোখে ঘুম নাই, কথা নাই মুখে, ভীতপাখিসম এলে মোর বুকে-- আছে আছে বিধি, এখনো অনেক রয়েছে বাকি। আমারো ভাগ্যে ঘটে নি ঘটে নি সকলি ফাঁকি।
বাবা যদি রামের মতো পাঠায় আমায় বনে যেতে আমি পারি নে কি তুমি ভাবছ মনে? চোদ্দ বছর ক' দিনে হয় জানি নে মা ঠিক, দণ্ডক বন আছে কোথায় ওই মাঠে কোন্ দিক। কিন্তু আমি পারি যেতে, ভয় করি নে তাতে-- লক্ষ্ণণ ভাই যদি আমার থাকত সাথে সাথে। বনের মধ্যে গাছের ছায়ায় বেঁধে নিতেম ঘর-- সামনে দিয়ে বইত নদী, পড়ত বালির চর। ছোটো একটি থাকত ডিঙি পারে যেতেম বেয়ে-- হরিণ চ'রে বেড়ায় সেথা, কাছে আসত ধেয়ে। গাছের পাতা খাইয়ে দিতেম আমি নিজের হাতে-- লক্ষ্ণণ ভাই যদি আমার থাকত সাথে সাথে। কত যে গাছ ছেয়ে থাকত কত রকম ফুলে, মালা গেঁথে পরে নিতেম জড়িয়ে মাথার চুলে। নানা রঙের ফলগুলি সব ভুঁয়ে পড়ত পেকে, ঝুড়ি ভরে ভরে এনে ঘরে দিতেম রেখে; খিদে পেলে দুই ভায়েতে খেতেম পদ্মপাতে-- লক্ষ্ণণ ভাই যদি আমার থাকত সাথে সাথে। রোদের বেলায় অশথ-তলায় ঘাসের 'পরে আসি রাখাল-ছেলের মতো কেবল বাজাই বসে বাঁশি। ডালের 'পরে ময়ূর থাকে, পেখম পড়ে ঝুলে-- কাঠবিড়ালি ছুটে বেড়ায় ন্যাজটি পিঠে তুলে। কখন আমি ঘুমিয়ে যেতেম দুপুরবেলার তাতে-- লক্ষ্ণণ ভাই যদি আমার থাকত সাথে সাথে। সন্ধেবেলায় কুড়িয়ে আনি শুকোনো ডালপালা, বনের ধারে বসে থাকি আগুন হলে জ্বালা। পাখিরা সব বাসায় ফেরে, দূরে শেয়াল ডাকে, সন্ধেতারা দেখা যে যায় ডালের ফাঁকে ফাঁকে। মায়ের কথা মনে করি বসে আঁধার রাতে -- লক্ষ্ণণ ভাই যদি আমার থাকত সাথে সাথে। ঠাকুরদাদার মতো বনে আছেন ঋষি মুনি, তাঁদের পায়ে প্রণাম করে গল্প অনেক শুনি। রাক্ষসেরে ভয় করি নে, আছে গুহক মিতা -- রাবণ আমার কী করবে মা, নেই তো আমার সীতা। হনুমানকে যত্ন করে খাওয়াই দুধে-ভাতে-- লক্ষ্ণণ ভাই যদি আমার থাকত সাথে সাথে। মা গো, আমায় দে-না কেন একটি ছোটো ভাই-- দুইজনেতে মিলে আমরা বনে চলে যাই। আমাকে মা, শিখিয়ে দিবি রাম-যাত্রার গান, মাথায় বেঁধে দিবি চুড়ো, হাতে ধনুক-বাণ। চিত্রকূটের পাহাড়ে যাই এম্নি বরষাতে-- লক্ষ্ণণ ভাই যদি আমার থাকত সাথে সাথে।