তখন আমার বয়স ছিল সাত। ভোরের বেলায় দেখতেম জানলা দিয়ে অন্ধকারের উপরকার ঢাকা খুলে আসছে, বেরিয়ে আসছে কোমল আলো নতুন-ফোটা কাঁটালিচাঁপার মতো। বিছানা ছেড়ে চলে যেতেম বাগানে কাক ডাকবার আগে, পাছে বঞ্চিত হই কম্পমান নারকেল শাখাগুলির মধ্যে সূর্যোদয়ের মঙ্গলাচরণে। তখন প্রতিদিনটি ছিল স্বতন্ত্র, ছিল নতুন। যে প্রভাত পূর্বদিকের সোনার ঘাট থেকে আলোতে স্নান করে আসত রক্তচন্দনের তিলক এঁকে ললাটে, সে আমার জীবনে আসত নতুন অতিথি, হাসত আমার মুখে চেয়ে।-- আগেকার দিনের কোনো চিহ্ন ছিল না তার উত্তরীয়ে। তারপরে বয়স হল কাজের দায় চাপল মাথার 'পরে। দিনের পরে দিন তখন হল ঠাসাঠাসি। তারা হারাল আপনার স্বতন্ত্র মর্যাদা। একদিনের চিন্তা আর-একদিনে হল প্রসারিত, একদিনের কাজ আর-একদিনে পাতল আসন। সেই একাকার-করা সময় বিস্তৃত হতে থাকে নতুন হতে থাকে না। একটানা বয়েস কেবলি বেড়ে ওঠে, ক্ষণে ক্ষণে শমে এসে চিরদিনের ধুয়োটির কাছে ফিরে ফিরে পায় না আপনাকে। আজ আমার প্রাচীনকে নতুন ক'রে নেবার দিন এসেছে। ওঝাকে ডেকেছি, ভূতকে দেবে নামিয়ে। গুণীর চিঠিখানির জন্যে প্রতিদিন বসব এই বাগানটিতে, তাঁর নতুন চিঠি ঘুম-ভাঙার জানালাটার কাছে। প্রভাত আসবে আমার নতুন পরিচয় নিতে, আকাশে অনিমেষ চক্ষু মেলে আমাকে শুধাবে "তুমি কে?" আজকের দিনের নাম খাটবে না কালকের দিনে। সৈন্যদলকে দেখে সেনাপতি, দেখে না সৈনিককে;-- দেখে আপন প্রয়োজন, দেখে না সত্য, দেখে না স্বতন্ত্র মানুষের বিধাতাকৃত আশ্চর্যরূপ। এতকাল তেমনি করে দেখেছি সৃষ্টিকে, বন্দীদলের মতো প্রয়োজনের এক শিকলে বাঁধা। তার সঙ্গে বাঁধা পড়েছি সেই বন্ধনে নিজে। আজ নেব মুক্তি। সামনে দেখছি সমুদ্র পেরিয়ে নতুন পার। তাকে জড়াতে যাব না এ পারের বোঝার সঙ্গে। এ নৌকোয় মাল নেব না কিছুই যাব একলা নতুন হয়ে নতুনের কাছে।