যে-কথা বলিতে চাই, বলা হয় নাই, সে কেবল এই-- চিরদিবসের বিশ্ব আঁখিসম্মুখেই দেখিনু সহস্রবার দুয়ারে আমার। অপরিচিতের এই চির পরিচয় এতই সহজে নিত্য ভরিয়াছে গভীর হৃদয় সে-কথা বলিতে পারি এমন সরল বাণী আমি নাহি জানি। শূন্য প্রান্তরের গান বাজে ওই একা ছায়াবটে; নদীর এপারে ঢালু তটে চাষি করিতেছে চাষ; উড়ে চলিয়াছে হাঁস ওপারের জনশূন্য তৃণশূন্য বালুতীরতলে। চলে কি না চলে ক্লান্তস্রোত শীর্ণ নদী, নিমেষ-নিহত আধো-জাগা নয়নের মতো। পথখানি বাঁকা বহুশত বরষের পদচিহ্ন-আঁকা চলেছে মাঠের ধারে, ফসল-খেতের যেন মিতা, নদীসাথে কুটিরের বহে কুটুম্বিতা। ফাল্গুনের এ-আলোয় এই গ্রাম, ওই শূন্য মাঠ, ওই খেয়াঘাট, ওই নীল নদীরেখা, ওই দূর বালুকার কোলে নিভৃত জলের ধারে চখাচখি কাকলি-কল্লোলে যেখানে বসায় মেলা-- এই সব ছবি কতদিন দেখিয়াছে কবি। শুধু এই চেয়ে দেখা, এই পথ বেয়ে চলে যাওয়া, এই আলো, এই হাওয়া, এইমতো অস্ফুটধ্বনির গুঞ্জরণ, ভেসে-যাওয়া মেঘ হতে অকস্মাৎ নদীস্রোতে ছায়ার নিঃশব্দ সঞ্চরণ, যে আনন্দ-বেদনায় এ জীবন বারেবারে করেছে উদাস হৃদয় খুঁজিছে আজি তাহারি প্রকাশ।
শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে পড়ুক ঝরে তোমারি সুরটি আমার মুখের 'পরে বুকের 'পরে। পুরবের আলোর সাথে পড়ুক প্রাতে দুই নয়ানে- নিশীথের অন্ধকারে গভীর ধারে পড়ুক প্রাণে, নিশিদিন এই জীবনের সুখের 'পরে দুঃখের 'পরে শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে পড়ুক ঝরে। যে শাখায় ফুল ফোটে না ফল ধরে না একেবারে তোমার ওই বাদল-বায়ে দিক জাগায়ে সেই শাখারে। যা-কিছু জীর্ণ আমার দীর্ণ আমার জীবনহারা তাহারি স্তরে স্তরে পড়ুক ঝরে সুরের ধারা। নিশিদিন এই জীবনের তৃষার 'পরে ভুখের 'পরে শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে পড়ুক ঝরে।
এই তীর্থ-দেবতার ধরণীর মন্দির-প্রাঙ্গণে যে পূজার পুষ্পাঞ্জলি সাজাইনু সযত্ন চয়নে সায়াহ্নের শেষ আয়োজন; যে পূর্ণ প্রণামখানি মোর সারা জীবনের অন্তরের অনির্বাণ বাণী জ্বালায়ে রাখিয়া গেনু আরতির সন্ধ্যাদীপ-মুখে সে আমার নিবেদন তোমাদের সবার সম্মুখে হে মোর অতিথি যত। তোমরা এসেছ এ জীবনে কেহ প্রাতে, কেহ রাতে, বসন্তে, শ্রাবণ-বরিষনে; কারো হাতে বীণা ছিল, কেহ বা কম্পিত দীপশিখা এনেছিলে মোর ঘরে; দ্বার খুলে দুরন্ত ঝটিকা বার বার এনেছ প্রাঙ্গণে। যখন গিয়েছ চলে দেবতার পদচিহ্ন রেখে গেছ মোর গৃহতলে। আমার দেবতা নিল তোমাদের সকলের নাম; রহিল পূজায় মোর তোমাদের সবারে প্রণাম।