এই ছবি রাজপুতানার; এ দেখি মৃত্যুর পৃষ্ঠে বেঁচে থাকিবার দুর্বিষহ বোঝা। হতবুদ্ধি অতীতের এই যেন খোঁজা পথভ্রষ্ট বর্তমানে অর্থ আপনার, শূন্যেতে হারানো অধিকার। ঐ তার গিরিদুর্গে অবরুদ্ধ নিরর্থ ভ্রূকুটি ঐ তার জয়স্তম্ভ তোলে ক্রুদ্ধ মুঠি বিরুদ্ধ ভাগ্যের পানে। মৃত্যুতে করেছে গ্রাস তবুও যে মরিতে না জানে, ভোগ করে অসম্মান অকালের হাতে দিনে রাতে, অসাড় অন্তরে গ্লানি অনুভব নাহি করে, আপনারি চাটুবাক্যে আপনারে ভুলায় আশ্বাসে-- জানে না সে, পরিপূর্ণ কত শতাব্দীর পণ্যরথ উত্তীর্ণ না হতে পথ ভগ্নচক্র পড়ে আছে মরুর প্রান্তরে, ম্রিয়মাণ আলোকের প্রহরে প্রহরে বেড়িয়াছে অন্ধ বিভাবরী নাগপাশে; ভাষাভোলা ধূলির করুণা লাভ করি একমাত্র শান্তি তাহাদের। লঙ্ঘন যে করে নাই ভোলামনে কালের বাঁধের অন্তিম নিষেধসীমা-- ভগ্নস্তূপে থাকে তার নামহীন প্রচ্ছন্ন মহিমা; জেগে থাকে কল্পনার ভিতে ইতিবৃত্তহারা তার ইতিহাস উদার ইঙ্গিতে। কিন্তু এ নির্লজ্জ কারা! কালের উপেক্ষাদৃষ্টি-কাছে না থেকেও তবু আছে। একি আত্মবিস্মরণমোহ, বীর্যহীন ভিত্তি-'পরে কেন রচে শূন্য সমারোহ। রাজ্যহীন সিংহাসনে অত্যুক্তির রাজা, বিধাতার সাজা।
হোথা যারা মাটি করে চাষ রৌদ্রবৃষ্টি শিরে ধরি বারো মাস, ওরা কভু আধামিথ্যা রূপে সত্যেরে তো হানে না বিদ্রূপে। ওরা আছে নিজ স্থান পেয়ে; দারিদ্র৻ের মূল্য বেশি লুপ্তমূল্য ঐশ্বর্যের চেয়ে। এদিকে চাহিয়া দেখো টিটাগড়। লোষ্ট্রে লৌহে বন্দী হেথা কালবৈশাখীর পণ্যঝড়। বণিকের দম্ভে নাই বাধা, আসমুদ্র পৃথ্বীতলে দৃপ্ত তার অক্ষুণ্ন মর্যাদা। প্রয়োজন নাহি জানে ওরা ভূষণে সাজায়ে হাতিঘোড়া সম্মানের ভান করিবার, ভুলাইতে ছদ্মবেশী সমুচ্চ তুচ্ছতা আপনার। শেষের পংক্তিতে যবে থামিবে ওদের ভাগ্যলিখা, নামিবে অন্তিম যবনিকা, উত্তাল রজতপিণ্ড-উদ্ধারের শেষ হবে পালা, যন্ত্রের কিঙ্করগুলো নিয়ে ভস্মডালা লুপ্ত হবে নেপথ্যে যখন, পশ্চাতে যাবে না রেখে প্রেতের প্রগল্ভ প্রহসন। উদাত্ত যুগের রথে বল্গাধরা সে রাজপুতানা মরুপ্রস্তরের স্তরে একদিন দিল মুষ্টি হানা; তুলিল উদ্ভেদ করি কলোল্লোলে মহা-ইতিহাস প্রাণে উচ্ছ্বসিত, মৃত্যুতে ফেনিল; তারি তপ্তশ্বাস স্পর্শ দেয় মনে, রক্ত উঠে আবর্তিয়া বুকে-- সে যুগের সুদূর সম্মুখে স্তব্ধ হয়ে ভুলি এই কৃপণ কালের দৈন্যপাশে- জর্জরিত, নতশির অদৃষ্টের অট্টহাসে, গলবদ্ধ পশুশ্রেণীসম চলে দিন পরে দিন লজ্জাহীন। জীবনমৃত্যুর দ্বন্দ্ব-মাঝে সেদিন যে দুন্দুভি মন্দ্রিয়াছিল তার প্রতিধ্বনি বাজে প্রাণের কুহরে গুমরিয়া। নির্ভয় দুর্দান্ত খেলা, মনে হয়, সেই তো সহজ, দূরে নিক্ষেপিয়া ফেলা আপনারে নিঃসংশয় নিষ্ঠুর সংকটে। তুচ্ছ প্রাণ নহে তো সহজ; মৃত্যুর বেদিতে যার কোনো দান নাই কোনো কালে সেই তো দুর্ভর অতি, আপনার সঙ্গে নিত্য বাল্যপনা দুঃসহ দুর্গতি। প্রচণ্ড সত্যেরে ভেঙে গল্পে রচে অলস কল্পনা নিষ্কর্মার স্বাদু উত্তেজনা, নাট্যমঞ্চে ব্যঙ্গ করি বীরসাজে তারস্বর আস্ফালনে উন্মত্ততা করে কোন্ লাজে। তাই ভাবি হে রাজপুতানা, কেন তুমি মানিলে না যথাকালে প্রলয়ের মানা, লভিলে না বিনষ্টির শেষ স্বর্গলোক; জনতার চোখ দীপ্তিহীন কৌতুকের দৃষ্টিপাতে পলে পলে করে যে মলিন। শঙ্করের তৃতীয় নয়ন হতে সম্মান নিলে না কেন যুগান্তের বহ্নির আলোতে।
আজি মানুষের সব সাধনার কুৎসিত বিদ্রূপ দিকে দিগন্তে করিছে প্রচার দানবিকতার রূপ। আমার আয়ুর প্রদোষ গগনে এ কুশ্রী বিভীষিকা দেখিতে হবে কি দারুণ লগনে জ্বালায় প্রলয়শিখা!