নিষ্ফল হয়েছি আমি সংসারের কাজে, লোকমাঝে আঁখি তুলে পারি না চাহিতে। ভাসায়ে জীবনতরী সাগরের মাঝে তরঙ্গ লঙ্ঘন করি পারি না বাহিতে। পুরুষের মতো যত মানবের সাথে যোগ দিতে পারি নাকো লয়ে নিজ বল, সহস্র সংকল্প শুধু ভরা দুই হাতে বিফলে শুকায় যেন লক্ষ্ণণের ফল। আমি গাঁথি আপনার চারি দিক ঘিরে সূক্ষ্ণ রেশমের জাল কীটের মতন। মগ্ন থাকি আপনার মধুর তিমিরে, দেখি না এ জগতের প্রকাণ্ড জীবন। কেন আমি আপনার অন্তরালে থাকি! মুদ্রিত পাতার মাঝে কাঁদে অন্ধ আঁখি।
রাহুর মতন মৃত্যু শুধু ফেলে ছায়া, পারে না করিতে গ্রাস জীবনের স্বর্গীয় অমৃত জড়ের কবলে এ কথা নিশ্চিত মনে জানি। প্রেমের অসীম মূল্য সম্পূর্ণ বঞ্চনা করি লবে হেন দস্যু নাই গুপ্ত নিখিলের গুহা-গহ্বরেতে এ কথা নিশ্চিত মনে জানি। সবচেয়ে সত্য ক'রে পেয়েছিনু যারে সবচেয়ে মিথ্যা ছিল তারি মাঝে ছদ্মবেশ ধরি, অস্তিত্বের এ কলঙ্ক কভু সহিত না বিশ্বের বিধান এ কথা নিশ্চিত মনে জানি। সব-কিছু চলিয়াছে নিরন্তর পরিবর্তবেগে সেই তো কালের ধর্ম। মৃত্যু দেখা দেয় এসে একান্তই অপরিবর্তনে, এ বিশ্বে তাই সে সত্য নহে এ কথা নিশ্চিত মনে জানি। বিশ্বেরে যে জেনেছিল আছে ব'লে সেই তার আমি অস্তিত্বের সাক্ষী সেই, পরম আমির সত্যে সত্য তার এ কথা নিশ্চিত মনে জানি।
জানি আমি মোর কাব্য ভালোবেসেছেন মোর বিধি, ফিরে যে পেলেন তিনি দ্বিগুণ আপন-দেওয়া নিধি। তাঁর বসন্তের ফুল বাতাসে কেমন বলে বাণী সে যে তিনি মোর গানে বারম্বার নিয়েছেন জানি। আমি শুনায়েছি তাঁরে শ্রাবণরাত্রির বৃষ্টিধারা কী অনাদি বিচ্ছেদের জাগায় বেদন সঙ্গীহারা। যেদিন পূর্ণিমা-রাতে পুষ্পিত শালের বনে বনে শরীরী ছায়ার মতো একা ফিরি আপনার মনে গুঞ্জরিয়া অসমাপ্ত সুর, শালের মঞ্জরী যত কী যেন শুনিতে চাহে ব্যগ্রতায় করি শির নত, ছায়াতে তিনিও সাথে ফেরেন নিঃশব্দ পদচারে বাঁশির উত্তর তাঁর আমার বাঁশিতে শুনিবারে। যেদিন প্রিয়ার কালো চক্ষুর সজল করুণায় রাত্রির প্রহর-মাঝে অন্ধকারে নিবিড় ঘনায় নিঃশব্দ বেদনা, তার দুটি হাতে মোর হাত রাখি স্তিমিত প্রদীপালোকে মুখে তার স্তব্ধ চেয়ে থাকি, তখন আঁধারে বসি আকাশের তারকার মাঝে অপেক্ষা করেন তিনি, শুনিতে কখন বীণা বাজে যে সুরে আপনি তিনি উন্মাদিনী অভিসারিণীরে ডাকিছেন সর্বহারা মিলনের প্রলয়তিমিরে।