সুশ্রী নয় এমন লোকের অভাব নেই জগতে-- এ মানুষটি তার চেয়েও বেশি, এ অদ্ভুত। খাপছাড়া টাক সামনের মাথায়, ফুর্ফুরে চুল কোথাও সাদা কোথাও কালো। ছোটো ছোটো দুই চোখে নেই রোঁওয়া, ভ্রূ কুঁচকিয়ে কী দেখে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে, তার দেখাটা যেন চোখের উঞ্ছবৃত্তি। যেমন উঁচু তেমনি চওড়া নাকটা, সমস্ত মুখের সে বারো-আনি অংশীদার। কপালটা মস্ত-- তার উত্তর দিগন্তে নেই চুল, দক্ষিণ দিগন্তে নেই ভুরু। দাড়ি-গোঁফ-কামানো মুখে অনাবৃত হয়েছে বিধাতার শিল্পরচনার অবহেলা। কোথায় অলক্ষ্যে পড়ে আছে আল্পিন টেবিলের কোণে, তুলে নিয়ে সে বিঁধিয়ে রাখে জামায়-- তাই দেখে মুখ ফিরিয়ে মুচকে হাসে জাহাজের মেয়েরা; পার্সেল-বাঁধা টুকরো ফিতেটা সংগ্রহ করে মেঝের থেকে, গুটিয়ে গুটিয়ে তাতে লাগায় গ্রন্থি; ফেলে-দেওয়া খবরের কাগজ ভাঁজ করে রাখে টেবিলে। আহারে অত্যন্ত সাবধান-- পকেটে থাকে হজমি গুঁড়ো, খেতে বসেই সেটা খায় জলে মিশিয়ে, খাওয়ার শেষে খায় হজমি বড়ি। স্বল্পভাষী, কথা যায় বেধে-- যা বলে মনে হয় বোকার মতো। ওর সঙ্গে যখন কেউ পলিটিক্স্ বলে বুঝিয়ে বলে অনেক ক'রে-- ও থাকে চুপচাপ, কিছু বুঝল কি না বোঝা যায় না। চলেছি একসঙ্গে সাত দিন এক জাহাজে। অকারণে সকলে বিরক্ত ওর 'পরে, ওকে ব্যঙ্গ করে আঁকে ছবি, হাসে তাই নিয়ে পরস্পর। ওর নামে অত্যুক্তি বেড়ে চলেছে কেবলই, ওকে দিনে দিনে মুখে মুখে রচনা করে তুলছে সবাই। বিধির রচনায় ফাঁক থাকে, থাকে কোথাও কোথাও অস্ফুটতা। এরা ভরিয়ে তোলে এদের রচনা দৈনিক রাবিশ দিয়ে, খাঁটি সত্যের মতো চেহারা হয়, নিজেরা বিশ্বাস করে। সবাই ঠিক করে রেখেছে ও দালাল, কেউ বা বলে রবারের কুঠির মেজো ম্যানেজার; বাজি রাখা চলছে আন্দাজ নিয়ে। সবাই ওকে পাশ কাটিয়ে চলে, সেটা ওর সয়ে গেছে আগে থাকতেই। চুরোট খাওয়ার ঘরে জুয়ো খেলে যাত্রীরা, ও তাদের এড়িয়ে চলে যায়, তারা ওকে গাল দেয় মনে মনে-- বলে কৃপণ, বলে ছোটোলোক। ও মেশে চাটগাঁয়ের খালাসিদের সঙ্গে। তারা কয় তাদের ভাষায়, ও বলে কী ভাষা কে জানে-- বোধ করি ওলন্দাজি। সকালে রবারের নল নিয়ে তারা ডেক ধোয়, ও তাদের মধ্যে গিয়ে লাফালাফি করে, তারা হাসে। ওদের মধ্যে ছিল এক অল্প বয়সের ছেলে-- শামলা রঙ, কালো চোখ, ঝাঁকড়া চুল, ছিপ্ছিপে গড়ন-- ও তাকে এনে দেয় আপেল কমলালেবু, তাকে দেখায় ছবির বই। যাত্রীরা রাগ করে য়ুরোপের অসম্মানে। জাহাজ এল শিঙাপুরে। খালাসিদের ডেকে ও তাদের দিল সিগারেট, আর দশটা করে টাকার নোট। ছেলেটাকে দিলে একটা সোনা-বাঁধানো ছড়ি। কাপ্তেনের কাছে বিদায় নিয়ে তড়্বড়্ করে নেমে গেল ঘাটে। তখন তার আসল নাম হয়ে গেল জানাজানি; যারা চুরোট ফোঁকার ঘরে তাস খেলত "হায় হায়' করে উঠল তাদের মন।