তোমাকে পাঠালুম আমার লেখা এক-বই-ভরা কবিতা তারা সবাই ঘেঁষাঘেঁষি দেখা দিল একই সঙ্গে এক খাঁচায়। কাজেই আর সমস্ত পাবে, কেবল পাবে না তাদের মাঝখানের ফাঁকগুলোকে। যে অবকাশের নীল আকাশের আসরে একদিন নামল এসে কবিতা সেইটেই পড়ে রইল পিছনে। নিশীথ রাত্রের তারাগুলি ছিঁড়ে নিয়ে যদি হার গাঁথা যায় ঠেসে, বিশ্ব-বেনের দোকানে হয়তো সেটা বিকোয় মোটা দামে; তবু রসিকেরা বুঝতে পারে, যেন কমতি হল কিসের। যেটা কম পড়ল সেটা ফাঁকা আকাশ, তৌল করা যায় না তাকে, কিন্তু সেটা দরদ দিয়ে ভরা। মনে করো একটি গান উঠল জেগে নীরব সময়ের বুকের মাঝখানে একটি মাত্র নীলকান্তমণি-- তাকে কি দেখতে হবে গয়নার বাক্সের মধ্যে। বিক্রমাদিত্যের সভায় কবিতা শুনিয়েছেন কবি দিনে দিনে। ছাপাখানার দৈত্য তখন কবিতার সময়াকাশকে দেয় নি লেপে কালি মাখিয়ে। হাইড্রলিক জাঁতায় পেষা কাব্যপিণ্ড তলিয়ে যেত না গলায় এক-এক গ্রাসে, উপভোগটা পুরো অবসরে উঠত রসিয়ে। হায় রে, কানে শোনার কবিতাকে পরানো হল চোখে দেখার শিকল, কবিতার নির্বাসন হল লাইব্রেরি-লোকে; নিত্যকালের আদরের ধন পাব্লিশরের হাটে হল নাকাল। উপায় নেই, জটলা-পাকানোর যুগ এটা। কবিতাকে পাঠকের অভিসারে যেতে হয় পটল-ডাঙার অম্নিবাসে চড়ে। মন বলছে নিশ্বাস ফেলে-- আমি যদি জন্ম নিতেম কালিদাসের কালে। তুমি যদি হতে বিক্রমাদিত্য আর আমি যদি হতেম-- কী হবে ব'লে। জন্মেছি ছাপার কালিদাস হয়ে। তোমরা আধুনিক মালবিকা কিনে পড় কবিতা আরাম-কেদারায় ব'সে। চোখ বুজে কান পেতে শোন না; শোনা হলে কবিকে পরিয়ে দাও না বেলফুলের মালা, দোকানে পাঁচ সিকে দিয়েই খালাস।
তোমারে শতধা করি ক্ষুদ্র করি দিয়া মাটিতে লুটায় যারা তৃপ্ত-সুপ্ত হিয়া সমস্ত ধরণী আজি অবহেলাভরে পা রেখেছে তাহাদের মাথার উপরে। মনুষ্যত্ব তুচ্ছ করি যারা সারাবেলা তোমারে লইয়া শুধু করে পূজা-খেলা মুগ্ধভাবভোগে, সেই বৃদ্ধ শিশুদল সমস্ত বিশ্বের আজি খেলার পুত্তল। তোমারে আপন-সাথে করিয়া সমান যে খর্ব বামনগণ করে অবমান কে তাদের দিবে মান! নিজ মন্ত্রস্বরে তোমারেই প্রাণ দিতে যারা স্পর্ধা করে কে তাদের দিবে প্রাণ! তোমারেও যারা ভাগ করে, কে তাদের দিবে ঐক্যধারা!
বাক্য তোমার সব লোকে বলে গজদন্তের তুল্য-- বের হয়ে যদি ফিরিত কবলে হারাত সত্য মূল্য। আঁখি-পানে তব তাকিয়েই বিশ্বাস মনে রাখি এই কথা দিলে তুমি ভোল না কখনো-- কত লোকে কত ভুলল।