তারা দিনের বেলা এসেছিল আমার ঘরে, বলেছিল, একটি পাশে রইব প'ড়ে। বলেছিল, দেবতা সেবায় আমরা হব তোমার সহায়-- যা কিছু পাই প্রসাদ লব পূজার পরে। এমনি করে দরিদ্র ক্ষীণ মলিন বেশে সংকোচেতে একটি কোণে রইল এসে। রাতে দেখি প্রবল হয়ে পশে আমার দেবালয়ে, মলিন হাতে পূজার বলি হরণ করে।
ঐ যেখানে শিরীষ গাছে ঝুরু-ঝুরু কচি পাতার নাচে ঘাসের 'পরে ছায়াখানি কাঁপায় থরথর ঝরা ফুলের গন্ধে ভরভর-- ঐখানে মোর পোষা হরিণ চরত আপন মনে হেনা-বেড়ার কোণে শীতের রোদে সারা সকালবেলা। তারি সঙ্গে করত খেলা পাহাড়-থেকে-আনা ঘন রাঙা রোঁয়ায় ঢাকা একটি কুকুরছানা। যেন তারা দুই বিদেশের দুটি ছেলে মিলেছে এক পাঠশালাতে, একসাথে তাই বেড়ায় হেসে খেলে। হাটের দিনে পথের কত লোকে বেড়ার কাছে দাঁড়িয়ে যেত, দেখত অবাক-চোখে। ফাগুন মাসে জাগল পাগল দখিন হাওয়া, শিউরে ওঠে আকাশ যেন কোন্ প্রেমিকের রঙিন-চিঠি-পাওয়া শালের বনে ফুলের মাতন হল শুরু, পাতায় পাতায় ঘাসে ঘাসে লাগল কাঁপন দুরুদুরু। হরিণ যে কার উদাস-করা বাণী হঠাৎ কখন শুনতে পেলে আমরা তা কি জানি। তাই যে কালো চোখের কোণে চাউনি তাহার উতল হল অকারণে; তাই সে থেকে থেকে হঠাৎ আপন ছায়া দেখে চমকে দাঁড়ায় বেঁকে। একদা এক বিকালবেলায় আমলকীবন অধীর যখন ঝিকিমিকি আলোর খেলায়, তপ্ত হাওয়া ব্যথিয়ে ওঠে আমের বোলের বাসে, মাঠের পরে মাঠ হয়ে পার ছুটল হরিণ নিরুদ্দেশের আশে। সম্মুখে তার জীবনমরণ সকল একাকার, অজানিতের ভয় কিছু নেই আর। ভেবেছিলেম আঁধার হলে পরে ফিরবে ঘরে চেনা হাতের আদর পাবার তরে। কুকুরছানা বারে বারে এসে কাছে ঘেঁষে ঘেঁষে কেঁদে-কেঁদে চোখের চাওয়ায় শুধায় জনে জনে, "কোথায় গেল, কোথায় গেল, কেন তারে না দেখি অঙ্গনে।" আহার ত্যেজে বেড়ায় সে যে, এল না তার সাথি। আঁধার হল, জ্বলল ঘরে বাতি; উঠল তারা; মাঠে-মাঠে নামল নীরব রাতি। আতুর চোখের প্রশ্ন নিয়ে ফেরে কুকুর বাইরে ঘরে, "নাই সে কেন, যায় কেন সে কাহার তরে।" কেন যে তা সে-ই কি জানে। গেছে সে যার ডাকে কোনো কালে দেখে নাই যে তাকে আকাশ হতে, আলোক হতে, নতুন পাতার কাঁচা সবুজ হতে দিশাহারা দখিন হাওয়ার স্রোতে রক্তে তাহার কেমন এলোমেলো কিসের খবর এল। বুকে যে তার বাজল বাঁশি বহুযুগের ফাগুন-দিনের সুরে-- কোথায় অনেক দূরে রয়েছে তার আপন চেয়ে আরো আপন জন। তারেই অন্বেষণ। জন্ম হতে আছে যেন মর্মে তারি লেগে, আছে যেন ছুটে চলার বেগে, আছে যেন চল-চপল চোখের কোণে জেগে। কোনো কালে চেনে নাই সে যারে সেই তো তাহার চেনাশোনার খেলাধুলা ঘোচায় একেবারে। আঁধার তারে ডাক দিয়েছে কেঁদে, আলোক তারে রাখল না আর বেঁধে।
বাবা যদি রামের মতো পাঠায় আমায় বনে যেতে আমি পারি নে কি তুমি ভাবছ মনে? চোদ্দ বছর ক' দিনে হয় জানি নে মা ঠিক, দণ্ডক বন আছে কোথায় ওই মাঠে কোন্ দিক। কিন্তু আমি পারি যেতে, ভয় করি নে তাতে-- লক্ষ্ণণ ভাই যদি আমার থাকত সাথে সাথে। বনের মধ্যে গাছের ছায়ায় বেঁধে নিতেম ঘর-- সামনে দিয়ে বইত নদী, পড়ত বালির চর। ছোটো একটি থাকত ডিঙি পারে যেতেম বেয়ে-- হরিণ চ'রে বেড়ায় সেথা, কাছে আসত ধেয়ে। গাছের পাতা খাইয়ে দিতেম আমি নিজের হাতে-- লক্ষ্ণণ ভাই যদি আমার থাকত সাথে সাথে। কত যে গাছ ছেয়ে থাকত কত রকম ফুলে, মালা গেঁথে পরে নিতেম জড়িয়ে মাথার চুলে। নানা রঙের ফলগুলি সব ভুঁয়ে পড়ত পেকে, ঝুড়ি ভরে ভরে এনে ঘরে দিতেম রেখে; খিদে পেলে দুই ভায়েতে খেতেম পদ্মপাতে-- লক্ষ্ণণ ভাই যদি আমার থাকত সাথে সাথে। রোদের বেলায় অশথ-তলায় ঘাসের 'পরে আসি রাখাল-ছেলের মতো কেবল বাজাই বসে বাঁশি। ডালের 'পরে ময়ূর থাকে, পেখম পড়ে ঝুলে-- কাঠবিড়ালি ছুটে বেড়ায় ন্যাজটি পিঠে তুলে। কখন আমি ঘুমিয়ে যেতেম দুপুরবেলার তাতে-- লক্ষ্ণণ ভাই যদি আমার থাকত সাথে সাথে। সন্ধেবেলায় কুড়িয়ে আনি শুকোনো ডালপালা, বনের ধারে বসে থাকি আগুন হলে জ্বালা। পাখিরা সব বাসায় ফেরে, দূরে শেয়াল ডাকে, সন্ধেতারা দেখা যে যায় ডালের ফাঁকে ফাঁকে। মায়ের কথা মনে করি বসে আঁধার রাতে -- লক্ষ্ণণ ভাই যদি আমার থাকত সাথে সাথে। ঠাকুরদাদার মতো বনে আছেন ঋষি মুনি, তাঁদের পায়ে প্রণাম করে গল্প অনেক শুনি। রাক্ষসেরে ভয় করি নে, আছে গুহক মিতা -- রাবণ আমার কী করবে মা, নেই তো আমার সীতা। হনুমানকে যত্ন করে খাওয়াই দুধে-ভাতে-- লক্ষ্ণণ ভাই যদি আমার থাকত সাথে সাথে। মা গো, আমায় দে-না কেন একটি ছোটো ভাই-- দুইজনেতে মিলে আমরা বনে চলে যাই। আমাকে মা, শিখিয়ে দিবি রাম-যাত্রার গান, মাথায় বেঁধে দিবি চুড়ো, হাতে ধনুক-বাণ। চিত্রকূটের পাহাড়ে যাই এম্নি বরষাতে-- লক্ষ্ণণ ভাই যদি আমার থাকত সাথে সাথে।