হাস্যদমনকারী গুরু-- নাম যে বশীশ্বর, কোথা থেকে জুটল তাহার ছাত্র হসীশ্বর। হাসিটা তার অপর্যাপ্ত, তরঙ্গে তার বাতাস ব্যাপ্ত, পরীক্ষাতে মার্কা যে তাই কাটেন মসীশ্বর। ডাকি সরস্বতী মাকে,-- 'ত্রাণ করো এই ছেলেটাকে, মাস্টারিতে ভর্তি করো হাস্যরসীশ্বর।'
যখন দিনের শেষে চেয়ে দেখি সমুখপানে সূর্য ডোবার দেশে মনের মধ্যে ভাবি অস্তসাগর-তলায় গেছে নাবি অনেক সূর্য-ডোবার সঙ্গে অনেক আনাগোনা, অনেক দেখাশোনা, অনেক কীর্তি, অনেক মূর্তি, অনেক দেবালয়, শক্তিমানের অনেক পরিচয়। তাদের হারিয়ে-যাওয়ার ব্যাথায় টান লাগে না মনে, কিন্তু যখন চেয়ে দেখি সামনে সবুজ বনে ছায়ায় চরছে গোরু, মাঝ দিয়ে তার পথ গিয়েছে সরু, ছেয়ে আছে শুক্নো বাঁশের পাতায়, হাট করতে চলে মেয়ে ঘাসের আঁঠি মাথায়, তখন মনে হঠাৎ এসে এই বেদনাই বাজে-- ঠাঁই রবে না কোনোকালেই ঐ যা-কিছুর মাঝে। ঐ যা-কিছুর ছবির ছায়া দুলেছে কোন্কালে শিশুর-চিত্ত-নাচিয়ে-তোলা ছড়াগুলির তালে-- তিরপূর্নির চরে বালি ঝুর্ঝুর্ করে, কোন্ মেয়ে সে চিকন-চিকন চুল দিচ্ছে ঝাড়ি, পরনে তার ঘুরে-পড়া ডুরে একটি শাড়ি। ঐ যা-কিছু ছবির আভাস দেখি সাঁঝের মুখে মর্ত্যধরার পিছু-ডাকা দোলা লাগায় বুকে।
এসেছি সুদূর কাল থেকে। তোমাদের কালে পৌঁছলেম যে সময়ে তখন আমার সঙ্গী নেই। ঘাটে ঘাটে কে কোথায় নেবে গেছে। ছোটো ছোটো চেনা সুখ যত, প্রাণের উপকরণ, দিনের রাতের মুষ্টিদান এসেছি নিঃশেষ করে বহুদূর পারে। এ জীবনে পা দিয়েছি প্রথম যে কালে সে কালের 'পরে অধিকার দৃঢ় হয়েছিল দিনে দিনে ভাবে ও ভাষায় কাজে ও ইঙ্গিতে, প্রণয়ের প্রাত্যহিক দেনাপাওনায়। হেসে খেলে কোনোমতে সকলের সঙ্গে বেঁচে থাকা, লোকযাত্রারথে কিছু কিছু গতিবেগ দেওয়া, শুধু উপস্থিত থেকে প্রাণের আসরে ভিড় জমা করা, এই তো যথেষ্ট ছিল। আজ তোমাদের কালে প্রবাসী অপরিচিত আমি। আমাদের ভাষার ইশারা নিয়েছে নূতন অর্থ তোমাদের মুখে। ঋতুর বদল হয়ে গেছে, -- বাতাসের উলটো-পালটা ঘ'টে প্রকৃতির হল বর্ণভেদ। ছোটো ছোটো বৈষম্যের দল দেয় ঠেলা, করে হাসাহাসি। রুচি আশা অভিলাষ যা মিশিয়ে জীবনের স্বাদ, তার হল রসবিপর্যয়। আমাদের সেকালকে যে সঙ্গ দিয়েছি যতই সামান্য হোক মূল্য তার তবু সেই সঙ্গসূত্রে গাঁথা হয়ে মানুষে মানুষে রচেছিল যুগের স্বরূপ, -- আমার সে সঙ্গ আজ মেলে না যে তোমাদের প্রত্যহের মাপে। কালের নৈবেদ্যে লাগে যে-সকল আধুনিক ফুল আমার বাগানে ফোটে না সে। তোমাদের যে বাসার কোণে থাকি তার খাজনার কড়ি হাতে নেই। তাই তো আমাকে দিতে হবে বড়ো কিছু দান দানের একান্ত দুঃসাহসে। উপস্থিত কালের যা দাবি মিটাবার জন্যে সে তো নয়, তাই যদি সেই দান তোমাদের রুচিতে না লাগে, তবে তার বিচার সে পরে হবে। তবু যা সম্বল আছে তাই দিয়ে একালের ঋণ শোধ করে অবশেষে ঋণী তারে রেখে যাই যেন। যা আমার লাভক্ষতি হতে বড়ো, যা আমার সুখদুঃখ হতে বেশি-- তাই যেন শেষ করে দিয়ে চলে যাই স্তুতি নিন্দা হিসাবের অপেক্ষা না রেখে।