"ওগো পথিক দিনের শেষে যাত্রা তোমার সে কোন্ দেশে, এ পথ গেছে কোন্খানে?" "কে জানে ভাই, কে জানে। চন্দ্রসূর্য-গ্রহতারার আলোক দিয়ে প্রাচীর-ঘেরা আছে যে এক নিকুঞ্জবন নিভৃতে, চরাচরের হিয়ার কাছে তারি গোপন দুয়ার আছে সেইখানে ভাই, করব গমন নিশীথে।" "ওগো পথিক, দিনের শেষে চলেছ যে এমন বেশে কে আছে বা সেইখানে?" "কে জানে ভাই, কে জানে। বুকের কাছে প্রাণের সেতার গুঞ্জরি নাম কহে যে তার, শুনেছিলাম জোৎস্নারাতের স্বপনে। অপূর্ব তার চোখের চাওয়া, অপূর্ব তার গায়ের হাওয়া, অপূর্ব তার আসা-যাওয়া গোপনে।" "ওগো পথিক, দিনের শেষে চলেছ যে এমন হেসে, কিসের বিলাস সেইখানে?" "কে জানে ভাই, কে জানে। জগৎজোড়া সেই সে ঘরে কেবল দুটি মানুষ ধরে আর সেখানে ঠাঁই নাহি তো কিছুরি; সেথা মেঘের কোণে কোণে কেবলি দেখি ক্ষণে ক্ষণে একটি নাচে আনন্দময় বিজুরি।" "ওগো পথিক, দিনের শেষে চলেছ যে,কেই বা এসে, পথ দেখাবে সেইখানে?" "কে জানে গো, কে জানে। শুনেছি সেই একটি বাণী পথ দেখাবার মন্ত্রখানি, লেখা আছে সকল আকাশ-মাঝে গো; সে মন্ত্র এই প্রাণের পারে অনাহত বীণার তারে গভীর সুরে বাজে সকাল-সাঁঝে গো।"
একটুখানি জায়গা ছিল রান্নাঘরের পাশে, সেইখানে মোর খেলা হ'ত শুক্নো-পারা ঘাসে। একটা ছিল ছাইয়ের গাদা মস্ত ঢিবির মতো, পোড়া কয়লা দিয়ে দিয়ে সাজিয়েছিলেম কত। কেউ জানে না সেইটে আমার পাহাড় মিছিমিছি, তারই তলায় পুঁতেছিলেম একটি তেঁতুল-বিচি। জন্মদিনের ঘটা ছিল, ছয় বছরের ছেলে-- সেদিন দিল আমার গাছে প্রথম পাতা মেলে। চার দিকে তার পাঁচিল দিলেম কেরোসিনের টিনে, সকাল বিকাল জল দিয়েছি, দিনের পরে দিনে। জল-খাবারের অংশ আমার এনে দিতেম তাকে, কিন্তু তাহার অনেকখানিই লুকিয়ে খেত কাকে। দুধ যা বাকি থাকত দিতেম জানত না কেউ সে তো-- পিঁপড়ে খেত কিছুটা তার, গাছ কিছু বা খেত। চিকন পাতায় ছেয়ে গেল, ডাল দিল সে পেতে-- মাথায় আমার সমান হল দুই বছর না যেতে। একটি মাত্র গাছ সে আমার একটুকু সেই কোণ, চিত্রকূটের পাহাড়-তলায় সেই হল মোর বন। কেউ জানে না সেথায় থাকেন অষ্টাবক্র মুনি-- মাটির 'পরে দাড়ি গড়ায়, কথা কন না উনি। রাত্রে শুয়ে বিছানাতে শুনতে পেতেম কানে রাক্ষসেরা পেঁচার মতো চেঁচাত সেইখানে। নয় বছরের জন্মদিনে তার তলে শেষ খেলা, ডালে দিলুম ফুলের মালা সেদিন সকাল-বেলা। বাবা গেলেন মুন্শিগঞ্জে রানাঘাটের থেকে, কোল্কাতাতে আমায় দিলেন পিসির কাছে রেখে। রাত্রে যখন শুই বিছানায় পড়ে আমার মনে সেই তেঁতুলের গাছটি আমার আঁস্তাকুড়ের কোণে। আর সেখানে নেই তপোবন, বয় না সুরধুনী-- অনেক দূরে চ'লে গেছেন অষ্টাবক্র মুনি।
কত লক্ষ বরষের তপস্যার ফলে ধরণীর তলে ফুটিয়াছে আজি এ মাধবী। এ আনন্দচ্ছবি যুগে যুগে ঢাকা ছিল অলক্ষ্যের বক্ষের আঁচলে। সেইমতো আমার স্বপনে কোনো দূর যুগান্তরে বসন্তকাননে কোনো এক কোণে একবেলাকার মুখে একটুকু হাসি উঠিবে বিকাশি-- এই আশা গভীর গোপনে আছে মোর মনে।