আমার যেতে ইচ্ছে করে নদীটির ওই পারে -- যেথায় ধারে ধারে বাঁশের খোঁটায় ডিঙি নৌকো বাঁধা সারে সারে। কৃষাণেরা পার হয়ে যায় লাঙল কাঁধে ফেলে; জাল টেনে নেয় জেলে, গোরু মহিষ সাঁৎরে নিয়ে যায় রাখালের ছেলে। সন্ধে হলে যেখান থেকে সবাই ফেরে ঘরে শুধু রাতদুপরে শেয়ালগুলো ডেকে ওঠে ঝাউডাঙাটার 'পরে। মা, যদি হও রাজি, বড়ো হলে আমি হব খেয়াঘাটের মাঝি। শুনেছি ওর ভিতর দিকে আছে জলার মতো। বর্ষা হলে গত ঝাঁকে ঝাঁকে আসে সেথায় চখাচখী যত। তারি ধারে ঘন হয়ে জন্মেছে সব শর; মানিক-জোড়ের ঘর, কাদাখোঁচা পায়ের চিহ্ন আঁকে পাঁকের 'পর। সন্ধ্যা হলে কত দিন মা, দাঁড়িয়ে ছাদের কোণে দেখেছি একমনে -- চাঁদের আলো লুটিয়ে পড়ে সাদা কাশের বনে। মা, যদি হও রাজি, বড়ো হলে আমি হব খেয়াঘাটের মাঝি। এ-পার ও-পার দুই পারেতেই যাব নৌকো বেয়ে। যত ছেলেমেয়ে স্নানের ঘাটে থেকে আমায় দেখবে চেয়ে চেয়ে। সূর্য যখন উঠবে মাথায় অনেক বেলা হলে -- আসব তখন চলে "বড়ো খিদে পেয়েছে গো -- খেতে দাও মা' বলে। আবার আমি আসব ফিরে আঁধার হলে সাঁঝে তোমার ঘরের মাঝে। বাবার মতো যাব না মা, বিদেশে কোন্ কাজে। মা, যদি হও রাজি, বড়ো হলে আমি হব খেয়াঘাটের মাঝি।
হৃদয়-পানে হৃদয় টানে, নয়ন-পানে নয়ন ছোটে, দুটি প্রাণীর কাহিনীটা এইটুকু বৈ নয়কো মোটে। শুক্লসন্ধ্যা চৈত্র মাসে হেনার গন্ধ হাওয়ায় ভাসে-- আমার বাঁশি লুটায় ভূমে, তোমার কোলে ফুলের পুঁজি। তোমার আমার এই-যে প্রণয় নিতান্তই এ সোজাসুজি। বাসন্তী-রঙ বসনখানি নেশার মতো চক্ষে ধরে, তোমার গাঁথা যূথীর মালা স্তুতির মতো বক্ষে পড়ে। একটু দেওয়া একটু রাখা, একটু প্রকাশ একটু ঢাকা, একটু হাসি একটু শরম-- দুজনের এই বোঝাবুঝি। তোমার আমার এই-যে প্রণয় নিতান্তই এ সোজাসুজি। মধুমাসের মিলন-মাঝে মহান কোনো রহস্য নেই, অসীম কোনো অবোধ কথা যায় না বেধে মনে-মনেই। আমাদের এই সুখের পিছু ছায়ার মতো নাইকো কিছু, দোঁহার মুখে দোঁহে চেয়ে নাই হৃদয়ের খোঁজাখুঁজি। মধুমাসে মোদের মিলন নিতান্তই এ সোজাসুজি। ভাষার মধ্যে তলিয়ে গিয়ে খুঁজি নে ভাই ভাষাতীত, আকাশ-পানে বাহু তুলে চাহি নে ভাই আশাতীত। যেটুকু দিই যেটুকু পাই তাহার বেশি আর কিছু নাই-- সুখের বক্ষ চেপে ধরে করি নে কেউ যোঝাযুঝি। মধুমাসে মোদের মিলন নিতান্তই এ সোজাসুজি। শুনেছিনু প্রেমের পাথার নাইকো তাহার কোনো দিশা, শুনেছিনু প্রেমের মধ্যে অসীম ক্ষুধা অসীম তৃষা-- বীণার তন্ত্রী কঠিন টানে ছিঁড়ে পড়ে প্রেমের তানে, শুনেছিনু প্রেমের কুঞ্জে অনেক বাঁকা গলিঘুঁজি। আমাদের এই দোঁহার মিলন নিতান্তই এ সোজাসুজি।