শিলঙে এক গিরির খোপে পাথর আছে খসে-- তারি উপর লুকিয়ে ব'সে রোজ সকালে গেঁথেছিলেম ভোরের সুরে গানের মালা। প্রথম সূর্যোদয়ের সঙ্গে ছিল আমার মুখোমুখির পালা। ডানদিকেতে অফলা এক পিচের শাখা ভরে ফুল ফোটে আর ফুল প'ড়ে যায় ঝরে। কালো ডানায় হলদে আভাস, কোন্ পাখি সেই অকারণের গানে ক্লান্তি নাহি জানে,-- তেমনিতরো গোলাপলতা লতাবিতান ঢেকে অজস্র তার ফুলের ভাষায় অন্ত না পায় উদ্দেশহীন ডেকে। পাইনবনের প্রাচীন তরু তাকায় মেঘের মুখে, ডালগুলি তার সবুজ ঝরনা ধরার পানে ঝুঁকে মন্ত্রে যেন থমক-লেগে আছে। দুটি দালিম গাছে ঘনসবুজ পাতার কোলে কোলে ঘনরাঙা ফুলের গুচ্ছ দোলে। পায়ের কাছে একটি কণ্টিকারি-- অন্তরঙ্গ কাছের সঙ্গ তারি, দূরের শূন্যে আপনাকে সে প্রচার নাহি করে। মাটির কাছে নত হলে পরে স্নিগ্ধ সাড়া দেয় সে ধীরে ধূলিশয়ন থেকে নীলবরনের ফুলের বুকে একটুখানি সোনার বিন্দু এঁকে। সেদিন যত রচেছিলাম গান কন্টিকারির দান তাদের সুরে স্বীকার করা আছে। আজকে যখন হৃদয় আমার ক্ষণিক শান্তি যাচে দুঃখদিনের দুর্ভাবনার প্রচণ্ড পীড়নে, হঠাৎ কেন জাগল আমার মনে, সেই সকালের টুকরো একটুখানি-- মাটির কাছে কণ্টিকারির নীল-সোনালির বাণী।
এ ধূসর জীবনের গোধূলি, ক্ষীণ তার উদাসীন স্মৃতি, মুছে-আসা সেই ম্লান ছবিতে রঙ দেয় গুঞ্জনগীতি। ফাগুনের চম্পক পরাগে সেই রঙ জাগে, ঘুমভাঙা কোকিলের কূজনে সেই রঙ লাগে, সেই রঙ পিয়ালের ছায়াতে ঢেলে দেয় পূর্ণিমাতিথি। এই ছবি ভৈরবী-আলাপে দোলে মোর কম্পিত বক্ষে, সেই ছবি সেতারের প্রলাপে মরীচিকা এনে দেয় চক্ষে, বুকের লালিম-রঙে রাঙানো সেই ছবি স্বপ্নের অভ্রতথি।