হে পদ্মা আমার, তোমায় আমায় দেখা শত শত বার। একদিন জনহীন তোমার পুলিনে, গোধূলির শুভলগ্নে হেমন্তের দিনে, সাক্ষী করি পশ্চিমের সূর্য অস্তমান তোমারে সঁপিয়াছিনু আমার পরান। অবসানসন্ধ্যালোকে আছিলে সেদিন নতমুখী বধূসম শান্ত বাক্যহীন; সন্ধ্যাতারা একাকিনী সস্নেহ কৌতুকে চেয়ে ছিল তোমাপানে হাসিভরা মুখে। সেদিনের পর হতে, হে পদ্মা আমার, তোমায় আমায় দেখা শত শত বার। নানা কর্মে মোর কাছে আসে নানা জন, নাহি জানে আমাদের পরানবন্ধন, নাহি জানে কেন আসি সন্ধ্যা-অভিসারে বালুকা শয়ন-পাতা নির্জন এ পারে। যখন মুখর তব চক্রবাকদল সুপ্ত থাকে জলাশয়ে ছাড়ি কোলাহল, যখন নিস্তব্ধ গ্রামে তব পূর্বতীরে রুদ্ধ হয়ে যায় দ্বার কুটিরে কুটিরে, তুমি কোন্ গান কর আমি কোন্ গান দুই তীরে কেহ তার পায় নি সন্ধান। নিভৃতে শরতে গ্রীষ্মে শীতে বরষায় শত বার দেখাশুনা তোমায় আমায়। কতদিন ভাবিয়াছি বসি তব তীরে পরজন্মে এ ধরায় যদি আসি ফিরে, যদি কোনো দূরতর জন্মভূমি হতে তরী বেয়ে ভেসে আসি তব খরস্রোতে-- কত গ্রাম কত মাঠ কত ঝাউঝাড় কত বালুচর কত ভেঙে-পড়া পাড় পার হয়ে এই ঠাঁই আসিব যখন জেগে উঠিবে না কোনো গভীর চেতন? জন্মান্তরে শতবার যে নির্জন তীরে গোপন হৃদয় মোর আসিত বাহিরে, আর বার সেই তীরে সে সন্ধ্যাবেলায় হবে না কি দেখাশুনা তোমায় আমায়?
বয়স তখন ছিল কাঁচা; হালকা দেহখানা ছিল পাখির মতো, শুধু ছিল না তার ডানা। উড়ত পাশের ছাদের থেকে পায়রাগুলোর ঝাঁক, বারান্দাটার রেলিং-'পরে ডাকত এসে কাক। ফেরিওয়ালা হেঁকে যেত গলির ওপার থেকে, তপসিমাছের ঝুড়ি নিত গামছা দিয়ে ঢেকে। বেহালাটা হেলিয়ে কাঁধে ছাদের 'পরে দাদা, সন্ধ্যাতারার সুরে যেন সুর হত তাঁর সাধা। জুটেছি বৌদিদির কাছে ইংরেজি পাঠ ছেড়ে, মুখখানিতে-ঘের-দেওয়া তাঁর শাড়িটি লালপেড়ে। চুরি ক'রে চাবির গোছা লুকিয়ে ফুলের টবে স্নেহের রাগে রাগিয়ে দিতেম নানান উপদ্রবে। কঙ্কালী চাটুজ্জে হঠাৎ জুটত সন্ধ্যা হলে; বাঁ হাতে তার থেলো হুঁকো, চাদর কাঁধে ঝোলে। দ্রুত লয়ে আউড়ে যেত লবকুশের ছড়া; থাকত আমার খাতা লেখা, পড়ে থাকত পড়া-- মনে মনে ইচ্ছে হত, যদিই কোনো ছলে ভর্তি হওয়া সহজ হত এই পাঁচালির দলে ভাব্না মাথায় চাপত নাকো ক্লাসে ওঠার দায়ে, গান শুনিয়ে চলে যেতুম নতুন নতুন গাঁয়ে। স্কুলের ছুটি হয়ে গেলে বাড়ির কাছে এসে হঠাৎ দেখি, মেঘ নেমেছে ছাদের কাছে ঘেঁষে। আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামে, রাস্তা ভাসে জলে, ঐরাবতের শুঁড় দেখা দেয় জল-ঢালা সব নলে। অন্ধকারে শোনা যেত রিম্ঝিমিনি ধারা, রাজপুত্র তেপান্তরে কোথা সে পথহারা। ম্যাপে যে-সব পাহাড় জানি, জানি যে-সব গাঙ কুয়েন্লুন আর মিসিসিপি ইয়াংসিকিয়াং, জানার সঙ্গে আধেক-জানা, দূরের থেকে শোনা, নানা রঙের নানা সুতোয় সব দিয়ে জাল-বোনা, নানারকম ধ্বনির সঙ্গে নানান চলাফেরা সব দিয়ে এক হালকা জগৎ মন দিয়ে মোর ঘেরা, ভাব্নাগুলো তারই মধ্যে ফিরত থাকি থাকি, বানের জলে শ্যাওলা যেমন, মেঘের তলে পাখি।