হয়েছে কি তবে সিংহদুয়ার বন্ধ রে? এখনো সময় আছে কি, সময় আছে কি? দূরে কলরব ধ্বনিছে মন্দ মন্দ রে-- ফুরালো কি পথ, এসেছি পুরীর কাছে কি? মনে হয় সেই সুদূর মধুর গন্ধ রে রহি রহি যেন ভাসিয়া আসিছে বাতাসে। বহু সংশয়ে বহু বিলম্ব করেছি, এখন বন্ধ্যা সন্ধ্যা আসিল আকাশে। ওই কি প্রদীপ দেখা যায় পুরমন্দিরে? ও যে দুটি তারা দূর পশ্চিমগগনে। ও কি শিঞ্জিত ধ্বনিছে কনকমঞ্জীরে? ঝিল্লির রব বাজে বনপথে সঘনে। মরীচিকালেখা দিগন্তপথ রঞ্জি রে সারাদিন আজি ছলনা করেছে হতাশে। বহু সংশয়ে বহু বিলম্ব করেছি, এখন বন্ধ্যা সন্ধ্যা আসিল আকাশে। এতদিনে সেথা বনবনান্ত নন্দিয়া নব বসন্তে এসেছে নবীন ভূপতি। তরুণ আশার সোনার প্রতিমা বন্দিয়া নব আনন্দে ফিরিছে যুবক যুবতী। বীণার তন্ত্রী আকুল ছন্দে ক্রন্দিয়া ডাকিছে সবারে আছে যারা দূর প্রবাসে। বহু সংশয়ে বহু বিলম্ব করেছি, এখন বন্ধ্যা সন্ধ্যা আসিল আকাশে। আজিকে সবাই সাজিয়াছে ফুলচন্দনে, মুক্ত আকাশে যাপিবে জ্যোৎস্নাযামিনী। দলে দলে চলে বাঁধাবাঁধি বাহুবন্ধনে, ধ্বনিছে শূন্যে জয়সংগীতরাগিণী। নূতন পতাকা নূতন প্রাসাদপ্রাঙ্গণে দক্ষিণবায়ে উড়িছে বিজয়বিলাসে। বহু সংশয়ে বহু বিলম্ব করেছি, এখন বন্ধ্যা সন্ধ্যা আসিল আকাশে। সারা নিশি ধরে বৃথা করিলাম মন্ত্রণা, শরৎ-প্রভাত কাটিল শূন্যে চাহিয়া। বিদায়ের কালে দিতে গেনু কারে সান্ত্বনা, যাত্রীরা হোথা গেল খেয়াতরী বাহিয়া। আপনারে শুধু বৃথা করিলাম বঞ্চনা, জীবন-আহুতি দিলাম কী আশাহুতাশে। বহু সংশয়ে বহু বিলম্ব করেছি, এখন বন্ধ্যা সন্ধ্যা আসিল আকাশে। প্রভাতে আমায় ডেকেছিল সবে ইঙ্গিতে, বহুজনমাঝে লয়েছিল মোরে বাছিয়া-- যবে রাজপথ ধ্বনিয়া উঠিল সংগীতে তখনো বারেক উঠেছিল প্রাণ নাচিয়া। এখন কি আর পারিব প্রাচীর লঙ্ঘিতে, দাঁড়ায়ে বাহিরে ডাকিব কাহারে বৃথা সে! বহু সংশয়ে বহু বিলম্ব করেছি, এখন বন্ধ্যা সন্ধ্যা আসিল আকাশে। তবু একদিন এই আশাহীন পন্থ রে অতি দূরে দূরে ঘুরে ঘুরে শেষে ফুরাবে, দীর্ঘ ভ্রমণ একদিন হবে অন্ত রে, শান্তিসমীর শ্রান্ত শরীর জুড়াবে। দুয়ার-প্রান্তে দাঁড়ায়ে বাহির-প্রান্তরে ভেরী বাজাইব মোর প্রাণপণ প্রয়াসে। বহু সংশয়ে বহু বিলম্ব করেছি, এখন বন্ধ্যা সন্ধ্যা আসিছে আকাশে।
নারীকে আর পুরুষকে যেই মিলিয়ে দিলেন বিধি পদ্য কাব্যে মানবজীবন পেল মিলের নিধি। কেবল যদি পুরুষ নিয়ে থাকত এ সংসার, গদ্য কাব্যে এই জীবনটা হ'ত একাক্কার। প্রোটন এবং ইলেক্ট্রনের যুগল মিলনেই জগৎটা যে পদ্য তাহার প্রমাণ হল সেই। জলে এবং স্থলে মিলে ছন্দে লাগায় তাল, আকাশেতে মহাগদ্য বিছান মহাকাল। কারণ তিনি তপস্বী যে বিশ্ব তাঁহার জ্ঞানে, প্রলয় তাঁহার ধ্যানে। সৃষ্টিকার্যে আলো এবং আঁধার অনন্ত কাল ধুয়ো ধরায় মিলের ছন্দ বাঁধার। জাগরণে আছেন তিনি শুদ্ধ জ্যোতির দেশে, আলো-আঁধার 'পরে তাঁহার স্বপ্ন বেড়ায় ভেসে। যারে বলি বাস্তব সে ছায়ার লিখন লিখা, অন্তবিহীন কল্পনাতে মহান মরীচিকা। বাস্তব যে অচল অটল বিশ্বকাব্যে তাই, তড়িৎকণার নৃত্য আছে বাস্তব তো নাই। গোলাপগুলোর পাপড়ি-চেয়ে শোভাটাই যে সত্য, কিন্তু শোভা কী পদার্থ কথায় হয় না কথ্য। বিশুদ্ধ ইঙ্গিত সে মাত্র, তাহার অধিক কী সে, কিসের বা ইঙ্গিত সে জিনিস, ভেবে কে পায় দিশে। নিউস্পেপার আছে পাবে প্রমাণযোগ্য বাক্য, মকদ্দমার দলিল আছে ঠিক কথাটার সাক্ষ্য। কাব্য বলে বেঠিক কথা, এক হয়ে যায় আর-- যেমন বেঠিক কথা বলে নিখিল সংসার। আজকে যাকে বাষ্প দেখি কালকে দেখি তারা, কেমন করে বস্তু বলি প্রকাণ্ড ইশারা। ফোটা-ঝরার মধ্যখানে এই জগতের বাণী কী যে জানায় কালে কালে স্পষ্ট কি তা জানি। বিশ্ব থেকে ধার নিয়েছি তাই আমরা কবি সত্য রূপে ফুটিয়ে তুলি অবাস্তবের ছবি। ছন্দ ভাষা বাস্তব নয়, মিল যে অবাস্তব-- নাই তাহাতে হাট-বাজারের গদ্য কলরব। হাঁ-য়ে না-য়ে যুগল নৃত্য কবির রঙ্গভূমে। এতক্ষণ তো জাগায় ছিলুম এখন চলি ঘুমে।