এ সংসারে আছে বহু অপরাধ, হেন অপবাদ যখন ঘোষণা কর উচ্চ হতে উষ্ণ উচ্চারণে, ভাবি মনে মনে, ক্রোধের উত্তাপ তার তোমার আপন অহংকার। মন্দ ও ভালোর দ্বন্দ্ব, কে না জানে চিরকাল আছে সৃষ্টির মর্মের কাছে। না যদি সে রহে বিশ্ব ঘেরি বিরুদ্ধ নির্ঘাতবেগে বাজে না শ্রেষ্ঠের জয়ভেরী। বিধাতার 'পরে মিথ্যা আনিয়ো না অভিযোগ মৃত্যুদুঃখ কর যবে ভোগ; মনে জেনো, মৃত্যুর মূল্যেই করি ক্রয় এ জীবনে দুর্মূল্য যা, অমর্ত যা, যা-কিছু অক্ষয়। ভাঙনের আক্রমণ সৃষ্টিকর্তা মানুষেরে আহ্বান করিছে অনুক্ষণ। দুর্গমের বক্ষে থাকে দয়াহীন শ্রেয়, রুদ্রতীর্থযাত্রীর পাথেয়। বহুভাগ্য সেই জন্মিয়াছি এমন বিশ্বেই নির্দোষ যা নয়। দুঃখ লজ্জা ভয় ছিন্ন সূত্রে জটিল গ্রন্থিতে রচনার সামঞ্জস্য পদে পদে রয়েছে খণ্ডিতে। এই ত্রুটি দেখেছি যখন শুনি নি কি সেই সঙ্গে বিশ্বব্যাপী গভীর ক্রন্দন যুগে যুগে উচ্ছ্বসিতে থাকে; দেখি নি কি আর্তচিত্ত উদ্বোধিয়া রাখে মানুষের ইতিবৃত্ত বেদনার নিত্য আন্দোলনে? উৎপীড়িত সেই জাগরণে তন্দ্রাহীন যে-মহিমা যাত্রা করে রাত্রির আঁধারে নমস্কার জানাই তাহারে। নানা নামে আসিছে সে নানা অস্ত্র হাতে কন্টকিত অসম্মান অবাধে দলিয়া পদপাতে-- মরণেরে হানি-- প্রলয়ের পান্থ সেই, রক্ত মোর তাহারে আহ্বানি।
যে গান গাহিয়াছিনু কবেকার দক্ষিণ বাতাসে সে গান আমার কাছে কেন আজ ফিরে ফিরে আসে শরতের অবসানে। সেদিনের সাহানার সুর আজি অসময়ে এসে অকারণে করিছে বিধুর মধ্যাহ্নের আকাশেরে; দিগন্তের অরণ্যরেখায় দূর অতীতের বাণী লিপ্ত আছে অস্পষ্ট লেখায়, তাহারে ফুটাতে চাহে। পথভ্রান্ত করুণ গুঞ্জনে মধু আহরিতে ফিরে, সেদিনের অকৃপণ বনে যে চামেলিবল্লী ছিল তারি শূন্য দানসত্র হতে। ছায়াতে যা লীন হল তারে খোঁজে নিষ্ঠুর আলোতে। শীতরিক্ত শাখা ছেড়ে পাখি গেছে সিন্ধুপারে চলি, তারি কুলায়ের কাছে সে কালের বিস্মৃত কাকলি বৃথাই জাগাতে আসে। যে তারকা অস্তে গেল দূরে তাহারি স্পন্দন ও-যে ধরিয়া এনেছে নিজ সুরে।