থাক্ থাক্, কাজ নাই, বলিয়ো না কোনো কথা। চেয়ে দেখি, চলে যাই, মনে মনে গান গাই, মনে মনে রচি বসে কত সুখ কত ব্যথা। বিরহী পাখির প্রায় অজানা কানন-ছায় উড়িয়া বেড়াক সদা হৃদয়ের কাতরতা-- তারে বাঁধিয়ো না ধরে, বলিয়ো না কোনো কথা। আঁখি দিয়ে যাহা বল সহসা আসিয়া কাছে সেই ভালো, থাক্ তাই, তার বেশি কাজ নাই, কথা দিয়ে বল যদি মোহ ভেঙে যায় পাছে। এত মৃদু, এত আধো, অশ্রুজলে বাধো-বাধো শরমে সভয়ে ম্লান এমন কি ভাষা আছে? কথায় বোলো না তাহা আঁখি যাহা বলিয়াছে। তুমি হয়তো বা পারো আপনারে বুঝাইতে-- মনের সকল ভাষা প্রাণের সকল আশা পারো তুমি গেঁথে গেঁথে রচিতে মধুর গীতে। আমি তো জানি নে মোরে, দেখি নাই ভালো করে মনের সকল কথা পশিয়া আপন চিতে-- কী বুঝিতে কী বুঝেছি, কী বলব কী বলিতে। তবে থাক্। ওই শোনো, অন্ধকারে শোনা যায় জলের কল্লোলস্বর পল্লবের মরমর-- বাতাসের দীর্ঘশ্বাস শুনিয়া শিহরে কায়। আরো ঊর্ধ্বে দেখো চেয়ে অনন্ত আকাশ ছেয়ে কোটি কোটি মৌন দৃষ্টি তারকায়। প্রাণপণ দীপ্ত ভাষা জ্বলিয়া ফুটিতে চায়। এস চুপ করে শুনি এই বাণী স্তব্ধতার-- এই অরণ্যের তলে কানাকানি জলে স্থলে, মনে করি হল বলা ছিল যাহা বলিবার। হয়তো তোমার ভাবে তুমি এক বুঝে যাবে, আমার মনের মতো আমি বুঝে যাব আর-- নিশীথের কন্ঠ দিয়ে কথা হবে দুজনার। মনে করি দুটি তারা জগতের এক ধারে পাশাপাশি কাছাকাছি তৃষাতুর চেয়ে আছি, চিনিতেছি চিরযুগ, চিনি নাকো কেহ কারে। দিবসের কোলাহলে প্রতিদিন যাই চলে, ফিরে আসি রজনীর ভাষাহীন অন্ধকারে-- বুঝিবার নহে যাহা চাই তাহা বুঝিবারে। তোমার সাহস আছে, আমার সাহস নাই। এই-যে শঙ্কিত আলো অন্ধকারে জ্বলে ভালো, কে বলিতে পারে বলো যাহা চাও এ কি তাই। তবে ইহা থাক্ দূরে কল্পনার স্বপ্নপুরে, যার যাহা মনে লয় তাই মনে করে যাই-- এই চির-আবরণ খুলে ফেলে কাজ নাই। এস তবে বসি হেথা, বলিয়ো না কোনো কথা। নিশীথের অন্ধকারে ঘিরে দিক দুজনারে, আমাদের দুজনের জীবনের নীরবতা। দুজনের কোলে বুকে আঁধারে বাড়ুক সুখে দুজনের এক শিশু জনমের মনোব্যথা। তবে আর কাজ নাই, বলিয়ো না কোনো কথা।
আমি ভিক্ষা করে ফিরতেছিলেম গ্রামের পথে পথে, তুমি তখন চলেছিলে তোমার স্বর্ণরথে। অপূর্ব এক স্বপ্ন-সম লাগতেছিল চক্ষে মম-- কী বিচিত্র শোভা তোমার, কী বিচিত্র সাজ। আমি মনে ভাবেতেছিলেম, এ কোন্ মহারাজ। আজি শুভক্ষণে রাত পোহালো ভেবেছিলেম তবে, আজ আমারে দ্বারে দ্বারে ফিরতে নাহি হবে। বাহির হতে নাহি হতে কাহার দেখা পেলেম পথে, চলিতে রথ ধনধান্য ছড়াবে দুই ধারে-- মুঠা মুঠা কুড়িয়ে নেব, নেব ভারে ভারে। দেখি সহসা রথ থেমে গেল আমার কাছে এসে, আমার মুখপানে চেয়ে নামলে তুমি হেসে। দেখে মুখের প্রসন্নতা জুড়িয়ে গেল সকল ব্যথা, হেনকালে কিসের লাগি তুমি অকস্মাৎ "আমায় কিছু দাও গো' বলে বাড়িয়ে দিলে হাত। মরি, এ কী কথা রাজাধিরাজ, "আমায় দাও গো কিছু'! শুনে ক্ষণকালের তরে রইনু মাথা-নিচু। তোমার কী-বা অভাব আছে ভিখারী ভিক্ষুকের কাছে। এ কেবল কৌতুকের বশে আমায় প্রবঞ্চনা। ঝুলি হতে দিলেম তুলে একটি ছোটো কণা। যবে পাত্রখানি ঘরে এনে উজাড় করি-- এ কী! ভিক্ষামাঝে একটি ছোটো সোনার কণা দেখি। দিলেম যা রাজ-ভিখারীরে স্বর্ণ হয়ে এল ফিরে, তখন কাঁদি চোখের জলে দুটি নয়ন ভরে-- তোমায় কেন দিই নি আমার সকল শূন্য করে।