বাঁশরি আনে আকাশ-বাণী- ধরণী আনমনে কিছু বা ভোলে কিছু বা আধো শোনে। নামিবে রবি অস্তপথে, গানের হবে শেষ-- তখন ফিরে ঘিরিবে তারে সুরের কিছু রেশ। অলস খনে কাঁপায় হাওয়া আধেকখানি-হারিয়ে-যাওয়া গুঞ্জরিত কথা, মিলিয়া প্রজাপতির সাথে রাঙিয়ে তোলে আলোছায়াতে দুইপহরে-রোদ-পোহানো গভীর নীরবতা। হল্দেরঙা-পাতায়-দোলা নাম-ভোলা ও বেদনা-ভোলা বিষাদ ছায়ারূপী ঘোমটা-পরা স্বপনময় দূরদিনের কী ভাষা কয় জানি না চুপিচুপি। জীবনে যারা স্মরণ-হারা তবু মরণ জানে না তারা, উদাসী তারা মর্মবাসী পড়ে না কভু চোখে-- প্রতিদিনের সুখ-দুখেরে অজানা হয়ে তারাই ঘেরে, বাষ্পছবি আঁকিয়া ফেরে প্রাণের মেঘলোকে।
নীরব বাঁশরিখানি বেজেছে আবার। প্রিয়ার বারতা বুঝি এসেছে আমার বসন্ত কানন মাঝে বসন্ত-সমীরে। তাই বুঝি মনে পড়ে ভোলা গান যত! তাই বুঝি ফুলবনে জাহ্নবীর তীরে পুরাতন হাসিগুলি ফুটে শত শত। তাই বুঝি হৃদয়ের বিস্মৃত বাসনা জাগিছে নবীন হয়ে পল্লবের মতো। জগৎ কমল বনে কমল-আসনা কতদিন পরে বুঝি তাই এল ফিরে। সে এল না এল তার মধুর মিলন, বসন্তের গান হয়ে এল তার স্বর, দৃষ্টি তার ফিরে এল, কোথা সে নয়ন? চুম্বন এসেছে তার, কোথা সে অধর?
তুমি অচিন মানুষ ছিলে গোপন আপন গহন-তলে, কেন এলে চেনার সাজে? তোমায় সাঁজ-সকালে পথে ঘাটে দেখি কতই ছলে আমার প্রতিদিনের মাঝে। তোমায় মিলিয়ে কবে নিলেন আপন আনাগোনার হাটে নানান পান্থদলের সাথে, তোমায় কখনো বা দেখি আমার তপ্ত ধুলার বাটে কভু বাদল-ঝরা রাতে। তোমার ছবি আঁকা পড়ল আমার মনের সীমানাতে আমার আপন ছন্দে ছাঁদা, আমার সরু মোটা নানা তুলির নানান রেখাপাতে তোমার স্বরূপ পড়ল বাঁধা। তাই আজি আমার ক্লান্ত নয়ন, মনের-চোখে-দেখা হল চোখের-দেখায় হারা। দোঁহার পরিচয়ের তরীখানা বালুর চরে ঠেকা, সে আর পায় না স্রোতের ধারা। ও যে অচিন মানুষ-- মন উহারে জানতে যদি চাহ জেনো মায়ার রঙমহলে, প্রাণে জাগুক্ তবে সেই মিলনের উৎসব-উৎসাহ যাহে বিরহদীপ জ্বলে। যখন চোখের সামনে বসতে দেবে তখন সে আসনে রেখো ধ্যানের আসন পেতে, যখন কইবে কথা সেই ভাষাতে তখন মনে মনে দিয়ো অশ্রুত সুর গেঁথে। তোমার জানা ভুবনখানা হতে সুদূরে তার বাসা, তোমার দিগন্তে তার খেলা। সেথায় ধরা-ছোঁওয়ার-অতীত মেঘে নানা রঙের ভাষা, সেথায় আলো-ছায়ার মেলা। তোমার প্রথম জাগরণের চোখে উষার শুকতারা যদি তাহার স্মৃতি আনে তবে যেন সে পায় ভাবের মূর্তি রূপের-বাঁধন-হারা তোমার সুর-বাহারের গানে।