কলছন্দে পূর্ণ তার প্রাণ-- নিত্য বহমান ভাষার কল্লোলে জাগাইয়া তোলে চারি ধারে প্রত্যহের জড়তারে; সংগীতে তরঙ্গ তুলি হাসিতে ফেনিল তার ছোটো দিনগুলি। আঁখি তার কথা কয়, বাহুভঙ্গি কত কথা বলে, চরণ যখন চলে কথা কয়ে যায়-- যে কথাটি অরণ্যের পাতায় পাতায়; যে কথাটি ঢেউ তোলে আশ্বিনে ধানের খেতে, প্রান্ত হতে প্রান্তে যায় চলে; যে কথাটি নিশীথতিমিরে, তারায় তারায় কাঁপে অধীর মির্মিরে; যে কথাটি মহুয়ার বনে মধুপগুঞ্জনে সারাবেলা উঠিছে চঞ্চলি-- নাম কি কাকলী।
চতুর্দিকে বহ্নিবাষ্প শূন্যাকাশে ধায় বহুদূরে, কেন্দ্রে তার তারাপুঞ্জ মহাকাল-চক্ররথে ঘুরে। কত বেগ, কত তাপ, কত ভার, কত আয়তন, সূক্ষ্ম অঙ্কে করেছে গণন পণ্ডিতেরা লক্ষ কোটি ক্রোশ দূর হতে দুর্লক্ষ্য আলোতে। আপনার পানে চাই, লেশমাত্র পরিচয় নাই। এ কি কোনো দৃশ্যাতীত জ্যোতি। কোন্ অজানারে ঘিরি এই অজানার নিত্য গতি। বহুযুগে বহুদূরে স্মৃতি আর বিস্মৃতি-বিস্তার, যেন বাষ্পপরিবেশ তার ইতিহাসে পিণ্ড বাঁধে রূপে রূপান্তরে। "আমি' উঠে ঘনাইয়া কেন্দ্র-মাঝে অসংখ্য বৎসরে। সুখদুঃখ ভালোমন্দ রাগদ্বেষ ভক্তি সখ্য স্নেহ এই নিয়ে গড়া তার সত্তাদেহ; এরা সব উপাদান ধাক্কা পায়, হয় আবর্তিত, পুঞ্জিত, নর্তিত। এরা সত্য কী যে বুঝি নাই নিজে। বলি তারে মায়া-- যাই বলি শব্দ সেটা, অব্যক্ত অর্থের উপচ্ছায়া। তার পরে ভাবি, এ অজ্ঞেয় সৃষ্টি "আমি' অজ্ঞেয় অদৃশ্যে যাবে নাবি। অসীম রহস্য নিয়ে মুহূর্তের নিরর্থকতায় লুপ্ত হবে নানারঙা জলবিম্বপ্রায়, অসমাপ্ত রেখে যাবে তার শেষকথা আত্মার বারতা। তখনো সুদূরে ঐ নক্ষত্রের দূত ছুটাবে অসংখ্য তার দীপ্ত পরমাণুর বিদ্যুৎ অপার আকাশ-মাঝে, কিছুই জানি না কোন্ কাজে। বাজিতে থাকিবে শূন্যে প্রশ্নের সুতীব্র আর্তস্বর, ধ্বনিবে না কোনোই উত্তর।