কে নিল খোকার ঘুম হরিয়া। মা তখন জল নিতে ও পাড়ার দিঘিটিতে গিয়াছিল ঘট কাঁখে করিয়া।-- তখন রোদের বেলা সবাই ছেড়েছে খেলা, ও পারে নীরব চখা-চখীরা; শালিক থেমেছে ঝোপে, শুধু পায়রার খোপে বকাবকি করে সখা-সখীরা; তখন রাখাল ছেলে পাঁচনি ধুলায় ফেলে ঘুমিয়ে পড়েছে বটতলাতে; বাঁশ-বাগানের ছায়ে এক-মনে এক পায়ে খাড়া হয়ে আছে বক জলাতে। সেই ফাঁকে ঘুমচোর ঘরেতে পশিয়া মোর ঘুম নিয়ে উড়ে গেল গগনে, মা এসে অবাক রয়, দেখে খোকা ঘর-ময় হামাগুড়ি দিয়ে ফিরে সঘনে। আমার খোকার ঘুম নিল কে। যেথা পাই সেই চোরে বাঁধিয়া আনিব ধরে, সে লোক লুকাবে কোথা ত্রিলোকে। যাব সে গুহার ছায়ে কালো পাথরের গায়ে কুলু কুলু বহে যেথা ঝরনা। যাব সে বকুলবনে নিরিবিলি সে বিজনে ঘুঘুরা করিছে ঘর-করনা। যেখানে সে-বুড়া বট নামায়ে দিয়েছে জট, ঝিল্লি ডাকিছে দিনে দুপুরে, যেখানে বনের কাছে বনদেবতারা নাচে চাঁদিনিতে রুনুঝুনু নূপুরে, যাব আমি ভরা সাঁঝে সেই বেণুবন-মাঝে আলো যেথা রোজ জ্বালে জোনাকি-- শুধাব মিনতি করে, "আমাদের ঘুমচোরে তোমাদের আছে জানাশোনা কি।' কে নিল খোকার ঘুম চুরায়ে। কোনোমতে দেখা তার পাই যদি একবার লই তবে সাধ মোর পুরায়ে। দেখি তার বাসা খুঁজি কোথা ঘুম করে পুঁজি, চোরা ধন রাখে কোন্ আড়ালে। সব লুঠি লব তার, ভাবিতে হবে না আর খোকার চোখের ঘুম হারালে ডানা দুটি বেঁধে তারে নিয়ে যাব নদীপারে সেখানে সে ব'সে এক কোণেতে জলে শরকাঠি ফেলে মিছে মাছ-ধরা খেলে দিন কাটাইবে কাশবনেতে। যখন সাঁঝের বেলা ভাঙিবে হাটের মেলা ছেলেরা মায়ের কোল ভরিবে, সারা রাত টিটি-পাখি টিটকারি দিবে ডাকি-- "ঘুমচোরা কার ঘুম হরিবে।'
ভাই নিশি, তখন উনিশ আমি, তুমি হবে বুঝি পঁচিশের কাছাকাছি। তোমার দুখানা বই ছাপা হয়ে গেছে-- "ক্ষান্তপিসি,' তার পরে "পঞ্চুর মৌতাত'। তা ছাড়া মাসিকপত্র কালচক্রে ক্রমে বের হল "রক্তের আঁচড়'। হুলুস্থূল পড়ে গেল দেশে। কলেজের সাহিত্যসভায়। সেদিন বলেছিলেম বঙ্কিমের চেয়ে তুমি বড়ো, তাই নিয়ে মাথা-ফাটাফাটি। আমাকে খ্যাপাত দাদা নিশি-পাওয়া ব'লে। কলেজের পালা-শেষে করেছি ডেপুটিগিরি, ইস্তফা দিয়েছি কাজে স্বদেশীর দিনে। তার পর থেকে, যা আমার সৌভাগ্য অভাবনীয় তাই ঘটে গেল-- বন্ধুরূপে পেলেম তোমাকে। কাছে পেয়ে কোনোদিন তোমাকে করি নি খাটো-- ছোটো বড়ো নানা ত্রুটি সেও আমি হেসে ভালোবেসে তোমার মহত্ত্বে সবই মিলিয়ে নিয়েছি। এ ধৈর্য, এ পূর্ণদৃষ্টি, এও যে তোমারি কাছে শেখা। দোষে ভরা অসামান্য প্রাণ, সে চরিত্র-রচনায় সব চেয়ে ওস্তাদি তোমার সে তো আমি জানি। তার পরে কতবার অনুরোধ করেছ কেবলই-- বলেছিলে, "লেখো, লেখো, গল্প লেখো। লেখকের মঞ্চে ছিল পিঠ-উঁচু তোমারি চৌকিটা। আত্ম-অবিশ্বাসে শুধু আটকে পড়েছ পড়ুয়ার নীচের বেঞ্চিতে।' শেষকালে বহু ইতস্তত ক'রে লেখা করলেম শুরু। বিষয়টা ঘটেছিল আমারি আমলে পান্তিঘাটায়। আসামি পোলিটিকাল, সাতমাস পলাতকা। মাকে দেখে যাবে বলে একদিন রাত্রে এসেছিল প্রাণ হাতে ক'রে। খুড়ো গেল পুলিসে খবর দিতে। কিছুদিন নিল সে আশ্রয় জেলেনীর ঘরে। যখন পড়ল ধরা সত্য সাক্ষ্য দিল খুড়ো, মিথ্যে সাক্ষ্য দিয়েছে জেলেনী। জেলেনীকে দিতে হল জেলে, খুড়ো হল সাব্রেজিস্ট্রার। গল্পখানা পড়ে বিস্তর বাহবা দিয়েছিলে। খাতাখানা নিজে নিয়ে শম্ভু সাণ্ডেলের ঘরে বলে এলে-- কালচক্রে অবিলম্বে বের হওয়া চাই। বের হল মাসে মাসে-- শুক্নো কাশে আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ল খ্যাতি নিমেষে নিমেষে। বাঁশরি'তে লিখে দিল-- কোথা লাগে আশুবাবু এ নবীন লেখকের কাছে। শুনে হেসেছিলে তুমি। পাঞ্চজন্যে লিখেছিল রতিকান্ত ঘোষ-- এত দিনে বাঙলা ভাষায় সত্য লেখা পাওয়া গেল ইত্যাদি ইত্যাদি। এবার হাস নি তুমি। তার পর থেকে তোমার আমার মাঝখানে খ্যাতির কাঁটার বেড়া ক্রমে ঘন হল। এখন আমার কথা শোনো। আমার এ খ্যাতি আধুনিক মত্ততার ইঞ্চিদুই পলিমাটি-'পরে হঠাৎ-গজিয়ে-ওঠা। স্টুপিড জানে না-- মূল এর বেশি দূর নয়; ফল এর কোনোখানে নেই, কেবলই পাতার ঘটা। তোমার যে পঞ্চু সে তো বাঙলার ডন্কুইক্সোট, তার যা মৌতাত সে যে জন্মখ্যাপাদের মগজে মগজে দেশে দেশে দেখা দেয় চিরকাল। আমার এ কুঞ্জলাল তুবড়ির মতো জ্বলে আর নেবে-- বোকাদের চোখে লাগে ধাঁধা। আমি জানি তুমি কতখানি বড়ো। এ ফাঁকা খ্যাতির চোরা মেকি পয়সায় বিকাব কি বন্ধুত্ব তোমার। কাগজের মোড়কটা খুলে দেখো, আমার লেখার দগ্ধশেষ। আজ বাদে কাল হ'ত ধুলো, আজ হোক ছাই।