যৌবনের অনাহূত রবাহূত ভিড়-করা ভোজে কে ছিল কাহার খোঁজে, ভালো করে মনে ছিল না তা। ক্ষণে ক্ষণে হয়েছে আসন পাতা, ক্ষণে ক্ষণে নিয়েছে সরায়ে। মালা কেহ গিয়েছে পরায়ে জেনেছিনু, তবু কে যে জানি নাই তারে। মাঝখানে বারে বারে কত কী যে এলোমেলো কভু গেল, কভু এল। সার্থকতা ছিল যেইখানে ক্ষণিক পরশি তারে চলে গেছি জনতার টানে। সে যৌবনমধ্যাহ্নের অজস্রের পালা শেষ হয়ে গেছে আজি, সন্ধ্যার প্রদীপ হল জ্বালা। অনেকের মাঝে যারে কাছে দেখে হয় নাই দেখা একেলার ঘরে তারে একা চেয়ে দেখি, কথা কই চুপে চুপে, পাই তারে না-পাওয়ার রূপে।
আজ এ মনের কোন্ সীমানায় যুগান্তরের প্রিয়া। দূরে-উড়ে-যাওয়া মেঘের ছিদ্র দিয়া কখনো আসিছে রৌদ্র কখনো ছায়া, আমার জীবনে তুমি আজ শুধু মায়া; সহজে তোমায় তাই তো মিলাই সুরে, সহজেই ডাকি সহজেই রাখি দূরে। স্বপ্নরূপিণী তুমি আকুলিয়া আছ পথ-খোওয়া মোর প্রাণের স্বর্গভূমি। নাই কোনো ভার, নাই বেদনার তাপ, ধূলির ধরায় পড়ে না পায়ের ছাপ। তাই তো আমার ছন্দে সহসা তোমার চুলের ফুলের গন্ধে জাগে নির্জন রাতের দীর্ঘশ্বাস, জাগে প্রভাতের পেলব তারায় বিদায়ের স্মিত হাস। তাই পথে যেতে কাশের বনেতে মর্মর দেয় আনি পাশ-দিয়ে-চলা ধানী-রঙ-করা শাড়ির পরশখানি। যদি জীবনের বর্তমানের তীরে আস কভু তুমি ফিরে স্পষ্ট আলোয়, তবে জানি না তোমার মায়ার সঙ্গে কায়ার কি মিল হবে। বিরহস্বর্গলোকে সে-জাগরণের রূঢ় আলোয় চিনিব কি চোখে-চোখে। সন্ধ্যাবেলায় যে-দ্বারে দিয়েছ বিরহকরুণ নাড়া, মিলনের ঘায়ে সে-দ্বার খুলিলে কাহারো কি পাবে সাড়া।
আমি শুধু বলেছিলেম -- "কদম গাছের ডালে পূর্ণিমা-চাঁদ আটকা পড়ে যখন সন্ধেকালে তখন কি কেউ তারে ধরে আনতে পারে।' শুনে দাদা হেসে কেন বললে আমায়, "খোকা, তোর মতো আর দেখি নাইকো বোকা। চাঁদ যে থাকে অনেক দূরে কেমন করে ছুঁই; আমি বলি, "দাদা, তুমি জান না কিচ্ছুই। মা আমাদের হাসে যখন ওই জানলার ফাঁকে তখন তুমি বলবে কি, মা অনেক দূরে থাকে।' তবু দাদা বলে আমায়, "খোকা, তোর মতো আর দেখি নাই তো বোকা।' দাদা বলে, "পাবি কোথায় অত বড়ো ফাঁদ।' আমি বলি, "কেন দাদা, ওই তো ছোটো চাঁদ, দুটি মুঠোয় ওরে আনতে পারি ধরে।' শুনে দাদা হেসে কেন বললে আমায়, "খোকা, তোর মতো আর দেখি নাই তো বোকা। চাঁদ যদি এই কাছে আসত দেখতে কত বড়ো।' আমি বলি, "কী তুমি ছাই ইস্কুলে যে পড়। মা আমাদের চুমো খেতে মাথা করে নিচু, তখন কি আর মুখটি দেখায় মস্ত বড়ো কিছু।' তবু দাদা বলে আমায়, "খোকা, তোর মতো আর দেখি নাই তো বোকা।'